এক করোনা অভিজ্ঞতা

করোনা নিয়ে আমাদের পরিবারের কদিন বেশ ভালোই অভিজ্ঞতা হল। তবে সেটাকে ভালো অভিজ্ঞতা বলা চলে বলে আমার মনে হয় না। 

বেশ কদিন আগে আমার বড় জেঠূকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বেশ কিছু শারীরিক অসুবিধার জন্যে তবে তার একটাও করোনার লক্ষণ নয়, সবকটি উপসর্গ আগের থেকেই উপস্থিত ছিল, সেগুলোই একটি প্রকট রূপ ধারণ করেছিল তাই বাধ্য হয়ে কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানে তাঁর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। সারা কলকাতা খুঁজেও একটিও করোনা বেড পাওয়া যায়নি। শেষমেশ তাঁকে দুর্গাপুর সনকা বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তবে সেখানেও কোনো বেড ফাঁকা ছিল না, কিন্তু আমাদের পরিবারের কিছুটা রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক “যোগাযোগ” থাকার ফলে কোনরকমে একটা স্পেশাল বেডের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হই। 

যাইহোক, জেঠুর অবস্থা আগের থেকেই ভালো ছিল না। তারসাথে আমরা পরিবারের সবাই বেশ তার উপর শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম তাঁর করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে। সেখানে করোনার চিকিৎসা ঠিক কেমন দেওয়া হয়েছিল বা আদৌ কি কোনো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে আমরা বেশ সন্ধিগ্ধ ছিলাম। দুর্ভাগ্যের কথা, ভর্তির পরের দিনই সন্ধ্যায় খবর আসে হাসপাতাল থেকে, জেঠু আর নেই! 

এবার শুরু আসল ঝামেলাটি। খবর পাওয়ার পর থেকে ফোনা-ফোনি শুরু হল লাশ ফেরত আনা নিয়ে, প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে সৎকার দুর্গাপুরেই হবে কিন্তু আমাদের জানানো হয় যে সেখানের চুল্লিতে এখন অনেক লম্বা লাইন, সৎকার করতেই প্রায় দুদিন লেগে যেতে পারে তাছাড়া এখন নাকি সরকার নিয়ম করেছে যে কোনো করোনা রোগী অন্য জেলায় মারা গেলে তাঁকে সমস্ত করোনা প্রটোকল মেনে দাহ নিজের জেলাতেই করতে হবে। লাশ পৌঁছানোর দায়িত্ব কিন্তু প্রশাসনের, কিন্তু রাতভর চেষ্টা করেও এর কোনো সুরাহা করা গেল না। আমাদের জানানো হয় যে সাব-ডিভিশনাল অফিসার ও লোকাল থানার কাছে অনুমতি পাওয়া গেলে তবেই কিছু ব্যবস্থা করা যাবে।

সকালে তো ফোনের মাধ্যমে সাব-ডিভিশনাল অফিসারের কাছে অনুমতি পাওয়া গেলেও লোকাল রঘুনাথপুর থানা বেঁকে বসে; তারা সাফ জানিয়ে দেয় তাদেরর প্রয়োজনীয় “ইনফ্রাস্ট্রাকচার” নেই। তারমানে নিজের জেলাতে দাহ করার উপায় থাকল না। হতাশ হয়ে আবার আমরা কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়, তারা জানাই যদি আমরা আসানসোলের কারো আধার কার্ড দিতে পারি তাহলে তারা সেখানের চুল্লিতে দাহের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। সেটাও করা হল। 

তবে আরেকবার শেষচেষ্টা করা হয়, কিন্তু বলা হয় আমাদের নিজস্বভাবে শববাহী গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। সেও করা হল, সন্ধ্যা সাতটাই আমাদের বাড়ির লোক দুর্গাপুরে পৌঁছে যায় জেঠুকে ফেরত আনার জন্য, কিন্তু গিয়ে দেখা যায়, তারাই আবার গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছে! আজব! 

এখানেই শেষ নয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবার একটি বিশাল অঙ্কের টাকার দাবি জানায়, নাহলে তারা বডি ছাড়বে না, ভাবার বিষয় একদিনেই তারা কি এমন চিকিৎসা করল যার জন্য বিল প্রায় চার লাখের উপরে উঠে গেলো, তাছাড়া আগেই আমাদের একলাখ টাকা ডিপোজিট করাই ছিল। এবারও আমাদের “যোগাযোগের” সাহায্যে তার এক সুরাহা হয়। শেষমেশ জেঠুকে ফিরিয়ে এনে, পুরুলিয়ায় দাহ করা হয়।

কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের পরিবারের অনেকেই করোনা টেস্ট করায়, কিন্তু সবারই নেগেটিভ আসে। 

 

এই হল আমাদের করোনা অভিজ্ঞতার কাহিনী। তিনবারের বিধায়ক আমার জেঠু, গোবিন্দ বাউরি, সাথে আমাদেরর ছিল অনেক “যোগাযোগ” তারপরেও যদি আমাদের এত ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হতে হয় তাহলে একেবারে সাধারণ মানুষ কি করবে, প্রথমে তো করোনা হলে তারা বেডই পাবে আর দৈবক্রমে যদি বেড পেয়েও যায়, রোগী মারা গেলে তো তারা সৎকারের জন্য দেহ ফেরতই আনতে পারবে না, তাদের তো নির্ঘাত “যা-পারবি-কর” বলে মরদেহ হাসপাতালে ছেড়েই চলে আসতে হবে!

✏️ শেষ সম্পাদনাঃ বুধ, 25 জানুয়ারি 2023 | 📎 লিঙ্ক
এক লেখাটি সম্পর্কে কোনো মতামত আছে 🤔? তাহলে আমাকে ইমেল পাঠান (নীচে দেওয়া আছে) কিংবা টুইটারে বা ফেসবুকে আমাকে @bauripalash মেনশন করে পোস্ট করুন 😺!

আমার লেখাগুলো বা অন্যকোনো কাজ ভালো লাগছে? তাহলে এক কাপ চা খাওয়ান

আরও পড়ুন