সংরক্ষণ দ্বন্দ্ব!
সত্যি করে বলছি, এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে আমার লেখার কোনোদিনই ইচ্ছা ছিল না। কারণ অনেক, তার মধ্যে কয়েকটি অন্যতম হল - বিষয়টি সমাজের একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে নিয়েই যে সম্প্রদায়ের অন্তর্গত আমি নিজেই আর তাছাড়া এইযুগে নিজেকে একটু রাজনৈতিকভাবে সঠিক রাখাই ভালো; কে বলতে পারে কোথাও থেকে কোনসময় হঠাৎ করে ব্যক্তিগত আক্রমণ ছুটে আসতে পারে। যাইহোক, অতশত না ভেবে ঠিক করলাম আজ লিখবই এবিষয়য়ে; কারণ আমার মনে হল লেখা দরকার!
তবে আমি আগেই বলে
রাখতে চাই, আমি এখানে তাদের প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করতে এখানে লিখতে শুরু
করিনি। আমি শুধু এখানে শুধু এটা আলোচনা করার জন্য যে তাদের মুল বক্তব্যে
কোথায় ত্রুটি রয়েছে এবং সেই ত্রুটিপূর্ণ দর্শনকে বাস্তবজীবনে ফলালে কী কী
বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
ফেসবুকে বা অন্যান্য সামাজিক মাধামে বিভিন্ন মানুষ বিশেষ
করে ভারতীয় সংবিধানের অসংরক্ষিত সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবাদের একঝড় তুলছে -
তাদের দাবি জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণ বন্ধ করতে হবে অর্থাৎ তফসিলি জাতি ও
তফসিলি উপজাতিদের জন্যে যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে সংবিধান
প্রণেতাদের দ্বারা সেটি প্রত্যহার করে, উপার্জন বা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে
সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
যে কেও এই উক্ত বাক্যগুলি যদি পড়ে তাহলে অনেকেরই মনে হতে
পারে যে , তাদের দাবি ন্যায্য। অনেক গরিব অসংরক্ষিত পরিবার আছে যাদের ঘরে
মেধা সম্পন্ন যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও তারা বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা
থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। মনের গভীর থেকে বলছি, তাদের জন্য আমার আজীবন
সমবেদনা ছিল, আছে এবং থাকবে; এবং আমিও এও মানছি যে এইসব প্রার্থীদের জন্য
বিশেষ কিছু ব্যবস্থার প্রয়োজন।
কিন্তু , আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এখনি এখনি ভারতের
সংবিধান থেকে জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণ তুলে দেওয়া যাবে না যতদিন না সমাজের
তথাকথিত নিচু জাতির মানুষেরা আর্থ-সামাজিক ভাবে সমাজের উঁচু জাতির
সমপর্যায়ে আসছে। তোমরা কল্পনা করতে পারো , আজকে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও
আমাদের খবরে দেখতে হয় - নিচু জাত বলে কল থেকে বা কুয়ো থেকে জল খাওয়ার
অধিকার নেই , নিচু জাত বলে মন্দিরে ঢুকতে পারে না, নিচু জাত বলে তাদের
মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, নিচু জাত বলে তাদের ন্যায়ের অধিকার নেই, নিচু জাত
বলে তাদের ধারে কাছে কেও ঘেঁষে না, নিচু জাত বলে তাদের সমাজে একঘরে করে
রাখা হয়…ইত্যাদি ইত্যাদি… আর কত বলব।
এইসব ফেসবুকের সমাজ সংস্কারকের কথায় - সংরক্ষিত জাতি
মানেই তারা অযোগ্য ও মেধাহীন। তাদের একটা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছিলাম যেখানে
তারা বলছে - “তুমি জাতি মানো না কিন্তু এদিকে আবার সংরক্ষণ কোটায় চাকরি
নাও” আমার শুধু একটাই বক্তব্য আছে - জাতি তারা মানে না তাদের জাতি মানতে
বাধ্য করা হয়। তাদের প্রত্যহিক জীবনে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে মনে করিয়ে
দেওয়া হয় তারা ছোট জাত, তারা ক্ষুদ্র, তারা নিচু জাত।
আমি আমার বাস্তবজীবনের দেখা একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ
করছি - কয়েকবছর আগে আমাদের পাড়াতে এক মহিলা ও তার পরিবার বাস করত। তারা ছিল
সমাজের উঁচু জাতের মানুষ । একবার তার শাড়িতে একবার ভুল করে মনে হয় আমার হাত
লেগে গেছিল। সেটা ছিল সন্ধ্যার সময়। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই তিনি স্নান
করেছিল সেই ভর সন্ধ্যা বেলাতে। আমার একটা সহজ প্রশ্ন, আমার মনে সেইসময়
কিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল?
এছাড়াও এরকম অনেক ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি। কই এইসব
ফেসবুকের সমাজসংস্কারক তো এইসব জিনিস নিয়ে কোনোদিন আন্দোলন করে
না!
আমিও জানি বর্তমান দেশের অবস্থা কী ,বেকারত্ব কিভাবে দিন
দিন বেড়ে চলেছে। তাই সাধারণভাবেই সংরক্ষণহীনদের মনে হতেই পারে যে তারা
বঞ্চিত হচ্ছেন । তাদের চাকরির ফর্ম ফিলাপ করার সময় সংরক্ষিতদের তুলনায় বেশি
টাকা ফিস লাগে , কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। কিন্তু
তারা একবারও তাদের চারপাশের সংরক্ষিত পরিবারগুলির আর্থিক অবস্থার দিকে চোখ
ফেরাতে চায় না।
আমিও জানি তুমিও জানো , যে সংরক্ষিত এমন অনেক পরিবার আছে
যারা আর্থিকভাবেই যথেষ্টই সচ্ছল এবং তাদের সংরক্ষণের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই
আবার অনেক অনেক অসংরক্ষিত পরিবার আছে যাদের আর্থিকঅবস্থা খুবই খারাপ এবং
তাদের সত্যিই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে। এবার যদি এই ১ শতাংশ মানুষ নিয়ে
গোটা সমাজটাকে বিচার করার চেষ্টা করি তাহলে তা হবে মুর্খামি। এই ১ শতাংশ
সংরক্ষিত মানুষকে দেখে আমার বলা অনুচিত হবে যে বাকি ৯৯% সংরক্ষিত মানুষও
সচ্ছল। আবার এও বলা অনুচিত যে , বাকি ৯৯% অসংরক্ষিত মানুষ আর্থিকভাবে
অসচ্ছল।
ফেসবুকের সমাজসংস্কারকদের কথা যদি মেনে নিয়ে, আমরা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করি তাহলে কী হবে?
কী হবে এই নিয়ে আমার মত ব্যক্ত করার আগে হাইস্কুলের একটা
ঘটনা তোমাদের সাথে শেয়ার করতে চাই - আমারা যখন হাইস্কুলে পড়তাম তখন আমাদের
প্রতিবছর বই কেনার জন্য ৪০০ টাকা দেওয়া হত সবাইকে, তবে এছাড়া আর্থিক ভাবে
পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বিশেষ কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা
থাকত, যাদের পরিবারের বার্ষিক আয় একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে তাদের বিশেষ
অর্থ পেত ড্রেস ইত্যাদি কেনার জন্য। আমার বাবা-মা যেহেতু চাকরি করে তাই
কোনোদিনই আমি সেই সুযোগ পাইনি , সে বিষয়ে আমার কোনোদিন কোনো ক্ষোভও নেই।
কিন্তু আমাদের কয়েকজন সহপাঠী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের কাছ থেকে জাল ইনকাম
সার্টিফিকেট বানিয়ে, সেই সুবিধা বেআইনি এবং অনৈতিক ভাবে ভোগ
করত।
অর্থাৎ বুঝতেই পারছ, মানুষ প্রতিটি ব্যবস্থারই “লুপহোল”
বের করে নিতে যথেষ্টই পটু। এবার এটার দায়িত্ব কে নেবে যে একই ভাবে ধনী
পুঁজিপতিরা জাল ইনকাম সার্টিফিকেট বানিয়ে সংরক্ষণের সুবিধা গ্রহণ করবে
না?
শেষমেশ দেখা যাবে , প্রাপ্যরা তো কেও সংরক্ষণ পেলই না ,
পেল ওই পাঁচতারা ফ্লাটে থাকা কোনো পুঁজিপতি ব্যবসায়ীর পরিবার! ব্যপার
হচ্ছে, কোনো ব্যবস্থাই শতভাগ অভেদ্য হয়না, কিছু ১ শতাংশ অযোগ্য মানুষ
যুগযুগ ধরে তাদের অপ্রাপ্য অধিকার ভোগ করে আসছে এবং করবে।
আরেকটা কাল্পনিক উদাহরণ দি, ধরো একটা নামি
দামি বেসরকারি কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে দুজন বন্ধু সুরেশ ও রমেশ আবেদন করেছে। সুরেশ হচ্ছে খুব গরিব কিন্তু সংরক্ষিত সম্প্রদায়ের এবং রমেশ হচ্ছে খুব অভিজাত ধনী পরিবারের কিন্তু অসংরক্ষিত সম্প্রদায়ের। দুজনের মেধাও প্রায় সমান। এবার যখন মেরিট লিস্ট বের হলো দেখা গেল সুরেশের নাম নেই কিন্তু রমেশের নাম আছে। আরে! এটা কী করে হলো? দেখা গেল আসলে রমেশের বাবা হলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং তিনি কলেজকে বেশ মোটা টাকার অনুদান দিয়েছেন বলেই তার ছেলের নাম মেরিট লিস্টে আছে আর সুরেশের বাবা বেশি অনুদান না দিতে সক্ষম হওয়ায় তার ছেলের নাম মেরিট লিস্টে নেই!
তাহলে দেখা গেল, শেষ কথা টাকায় বলে। টাকা যার, মুলুক তার!
তাহলে এত সব কাণ্ডের মধ্যে, কী করা যেতে পারে যাতে সবাই
যোগ্যরা অন্তত সুযোগ পায়? আমার মতে যতদিন না বেশিরভাগ সংরক্ষিত মানুষ
আর্থ-সামাজিক ভাবে অসংরক্ষিত মানুষদের সমপর্যায়ে আসছে ততদিন, একটা ব্যবস্থা
করা উচিত যে যারা আর্থিক ভাবে সচ্ছল তারা তাদের সংরক্ষণ স্বইচ্ছায় আইনিভাবে
ত্যাগ করতে পারে, যেমনটা ঠিক গ্যাসের ভর্তুকির ক্ষেত্রে করা হয়েছে; এবং
যেসব অসংরক্ষিত মানুষ অসচ্ছল তাদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে
, তবে কে সংরক্ষণের যোগ্য এটি যাচাই করার জন্য একটি স্বচ্ছ পদ্ধতির প্রয়োজন
, দরকার হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করতে হবে। নাহলে বাজারে যা জাল
সার্টিফিকেটের রমরমা দেখা যাবে সব পুঁজিপতিরা সব সংরক্ষণ হাতিয়ে বসে আছে 🤷♂️
!
আমি আগেই বলেছি কোনো ব্যবস্থায় শত ভাগ সঠিক হতে পারে না।
কিছু ত্রুটি থেকেই যায়। তবে আমার মতে যুগ যুগ ধরে তফসিলি জাতি ও উপজাতির
মানুষ যে ধরণের বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আসছে তাতে তাদের সংরক্ষণের
আওতায় রেখে খুব একটা ভুল কি ডঃ আম্বেদকর করেছেন?
কিন্তু কিছু উৎশৃঙ্খল যুবক যুবতী যেভাবে সামাজিক মাধ্যমে
ডঃ আম্বেদকরকে নিয়ে ট্রোল, জোকস বানিয়ে চলেছে, মনে হয় এরা ভুলেই গেছে, যে
সংবিধানের জোরে তারা তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষমতা অর্জন করেছে সেই
সংবিধানের প্রণেতা কিন্তু ডঃ আম্বেদকরই! সত্যি ভাবতে লজ্জা এরাই আমাদের
দেশের ভবিষ্যৎ!
সমাজের মুল সমস্যাগুলিকে চিনতে শেখো বন্ধু! নাহলে তুমি এদিকে মিম, জোকস শেয়ার করতে থাকবে আর ওদিকে দেশের নবীন মেরুদন্ড কখন যে বিক্রি হয়ে যাবে ডলারের বিনিময়ে ধরতেই পারবে না!
সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটা কবিতা মনে পড়ছে খুব এখন,
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না;
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
সত্যি কথা বলতে কি, ভারতবর্ষের মানুষ যেদিন নিজেদের অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ভুলে সবাই একসাথে হাতে হাত লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে যোগদান করবে সেদিনই গড়ে উঠবে এক লৌহ মেরুদন্ড যুক্ত দেশ।
দিক থেকে দিগন্ত শুধু বিভেদের বারুদ / ক্ষতবিক্ষত করে আমার মাতার হৃদয়।
~ পলাশ বাউরি