মুক্তচিন্তক ব্রুনো

আমি আজ চোখ বন্ধ করলেই কল্পনা করতে পারি আমি এক অন্তহীন অসীম সমুদ্রে আমার কল্পনার নৌকায় ভেসে চলছি, হাজার হাজার নক্ষত্র আমার চারপাশে ঘুরছে , সে তারাগুলোকে আবার প্রদক্ষিণ করছে কয়েকটা ছোট ছোট গোলক, গ্রহ; মাঝে মাঝে হুস করে উড়ে যাচ্ছে উজ্জ্বল ঝাঁটার মতো কয়েকটা জিনিস, দুরে আবার দেখা যাচ্ছে নানান রঙবেরঙের মেঘের মত জিনিস; কত কত গ্যালাক্সিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর দুরে গাড় অস্পষ্ট একটা কালো ছোপ ছোপ দেখা যাচ্ছে ওটা মনে হয় কৃষ্ণ গহ্বর।

এইসব কল্পনা করতে কার না ভালো লাগে, কিন্তু তুমি শুনলে অবাক হবে আজ থেকে প্রায় ৪২১ বছর আগে রোম দেশে একজন ব্যাক্তিকে জনসমক্ষে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় শুধুমাত্র এইসব কল্পনা করার অপরাধে! সেই ব্যক্তি ছিল - জিওর্দানো ব্রুনো!

 

ব্রুনো ছিলেন ইতালি দেশের একজন ডোমিনিকান ধর্মযাজক। তিনি চিরকালই ছিলেন মুক্তচিন্তক ও বিদ্রোহী চরিত্রের মানুষ। কিন্তু সেই সময় ইতালিতে মুক্ত চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা জনগণের ছিল না। কিন্তু ব্রুনো এইসব কিছুই না ভয় পেয়ে , বিশ্বকে জানায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি এমন অনেক বই পড়তেন যেগুলি সেইসময় ইতালিতে নিষিদ্ধ ছিল। তেমনি চার্চ দ্বারা নিষিদ্ধ একটি লেখা তিনি পড়ছিলেন - বিখ্যাত রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রেসিয়াসের লেখা দে রেরাম ন্যাচুরা (De rerum natura) যার ইংরাজি অর্থ হয় On the Nature of Things। সেই বই পড়ে তিনি অবিভুত হয়ে গেছিলেন।

সেই বইতে লেখক পাঠকদের মহাসৃষ্টির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে একটি তীর ছোঁড়ার কল্পনা করতে বলেন। তীরটি যদি কোথাও না আটকে এগিয়ে যেতেই থাকে তার মানে তুমি যেখানে মহাসৃষ্টির শেষ ভেবেছিলেন সেখানে তার শেষ নেই; আবার যদি তীর কোথাও আটকে যায় তার মানে এই হল সেই সীমানা যেখানে তুমি ভেবেছিলে মহাসৃষ্টির শেষ। এবার যদি আটকে যাওয়া স্থান থেকে আবার তীর ছোঁড়া হয় তাহলে উপরোক্ত দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো একটি ঘটবে। হয় তীর এগোতেই থাকবে নাহয় তীর কোথাও আটকে যাবে। আবার আটকে যাওয়া স্থান থেকে তীর ছুঁড়তে হবে - হয় আটকে যাবে নাহয় এগোতে থাকবে; এভাবে চলতে থাকবে। যেকোনো দুটি ক্ষেত্রেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড অসীম হবে। 

 

এই সিদ্ধান্ত পড়ে, ব্রুনো অবিভুত হয়ে গেলেন। তিনিও যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন সেই ঈশ্বরও ছিল অসীম তাই তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের সৃষ্টি করা মহাসৃষ্টিও ছিল অনন্ত। কিন্তু শেষমেশ চার্চের কোপদৃষ্টি পড়ল তার উপর এবং তাকে চার্চ থেকে বের করে দেওয়া হল। দুর্ভাগ্যবশত এরপর তিনি আর কোথাও কোনো কাজ পেলেন না। যখন তার বয়স ৩০ বছর তখন তিনি একদিন রাত্রে একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন যা তার ভাগ্য চিরতরে বদলে দিল - তিনি দেখলেন তিনি তারায় ভর্তি এক কাপড়ের গোলকের নিচে শুয়ে আছেন - তখনকার দিনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই ছিল সীমানা। তিনি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন গোলকের কিনারার দিকে। তিনি একটু ইতস্তত করছিলেন, সেই কাপড়ের গোলকের পর্দা সরিয়ে কি তিনি বাইরে উঁকি দেবেন? যদিও তার বুকে ছিল এক সুপ্ত ভয়, কিন্তু কোনরকম সাহস জুগিয়ে বেরিয়ে এলেন সেই গোলক থেকে! তিনি গোলক থেকে বেরিয়ে এসে অনুভব করলেন তিনি এক অসীম মহাকাশে পৌঁছে গেছেন - যেখানে কোনো উপর নেই , নীচ নেই , শেষ নেই , শুরু নেই। তিনি দেখলেন অসীম মহাকাশে সূর্যর মতোই অগুন্তিক নক্ষত্র আছে, যাদের চারপাশেও পৃথিবীর মতই গ্রহ ঘুরছে। তিনি এইসব জিনিস দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন - অন্যের জন্য যা ছিল দুরে, তাই তার কাছে হয়ে দাঁড়াল খুব কাছের। 

 

এরপর ব্রুনো হয়ে উঠলেন একজন ধর্মপ্রচারক। তিনি পুরো ইউরোপ ঘুরে ঘুরে অসীম মহাবিশ্বের মত প্রচার করতে লাগলেন। তাকে ইংল্যান্ডেরঅক্সফোর্ডে ভাষণ দেয়ার জন্য ডাকা হল, তিনি ভাবলেন এবার হয়তো তিনি এক বড় মঞ্চে তার মত প্রকাশের সুযোগ পাবেন। তিনি সেখানে বললেন কোপারনিকাসের দাবি একদম সঠিক ছিল কিন্তু সেটা ছিল সূচনা মাত্র , মহাবিশ্বে সূর্যের মত আরও অনেক নক্ষত্র আছে, তাদের চারপাশেও আমার পৃথিবীর মত অনেক গ্রহ প্রদক্ষিণ করে; তেমনি কোনো গ্রহে হয়তো জল আছে সাথে জীবজন্তুও আছে। কিন্তু হায়! তাকে অধর্মী , পাগল বলে অক্সফোর্ড থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হল। কিন্তু ব্রুনো বেপরোয়া হয়ে নিজের দেশে ইতালিতে ফিরে এলেন, যেটা ছিল তার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা। সেই সময় সেখানে ইনকুইজিসন নামক আদালতের প্রচলন ছিল, তাদের মুল কাজ ছিল যারা চার্চের মতের বিরুদ্ধে কথা বলতেন তাদের উপর মামলা-মোকদ্দমা চালিয়ে শাস্তি দেওয়া। শেষমেশ ব্রুনোও এই আদালতগুলির চক্রব্যূহে ফেঁসে গেলেন এবং তাকে কয়েকবছরের জন্য নোনা টাওয়ারে কারারুদ্ধ করে রাখা হল। সেইসময় তার ওপর চালানো হল অকথ্য অত্যাচার যাতে তিনি তার মতবাদ ত্যাগ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কারণ সাধারণ মানুষ যদি ব্রুনোর মতাদর্শ মানতে শুরু করে তাহলে সমস্ত ধার্মিক বই ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে এবং চার্চের ওপর তাদের আস্থাও উঠে যাবে। কিন্তু নিজের জেদ ধরে রাখলেন ব্রুনো; নিজের মত থেকে একচুলও নড়লেন না। তাকে চার্চের ইনকুইজিসনে শেষবারের মত ক্ষমাপ্রার্থনার সুযোগ দেওয়া হলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করলেন না। শেষমেশ ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি , ক্যথলিক ধর্মের অবমাননা ও ধর্মগুরুদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য তাকে ধর্মদ্রোহী বলে রায় দেওয়া হয় এবং মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। এই রায় শুনে ভয়হীন ব্রুনো বিচলিত না হয়ে বিচারকদের শাসিয়ে দিয়ে বলেন, “আপনারা হয়তো আমার সাথে হেরে যাবার ভয়ে আমার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছেন; আমি এটি গ্রহণ করলাম”। ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের এক কেন্দ্রীয় বাজার , ক্যম্পো দে ফিওরি (Campo de' Fiori) তে নিয়ে গিয়ে, জনগণের সামনে এক খুঁটির সাথে বেঁধে তাকে পুড়িয়ে মারা হয় এবং তার লিখিত বইগুলিও নষ্ট করে দেওয়া হয়। 

 

ব্রুনো কোনো বৈজ্ঞানিক ছিলেন না। তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে যা তার ধারনা ছিল তা ছিল তার আন্দাজ মাত্র। তা ভুলও হতে পারত কিন্তু তার মৃত্যুর প্রায় ১০ বছর পরই গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে দেখিয়ে দিলেন যে ব্রুনোর ধারনা সঠিক ছিল। কিন্তু চার্চ তার হাতে কলমে প্রমাণ করে দেওয়া দাবিও মানতে নারাজ ছিল এবং তাকে কিভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা আমাদের অজানা নয়। 

ব্রুনো তার মৃত্যুর পর বহুল খ্যাতি অর্জন করেন। কারণ তার ধারনাগুলি অনেকাংশই সঠিক ছিল। আস্তে আস্তে মানুষ তার কাজের কথা জানতে পারে। বিজ্ঞানীরাও তার ধারনাকে হাতে কলমে পরীক্ষা করতে শুরু করেন।

ব্রুনোকে মানুষজন “বিজ্ঞানের জন্য শহীদ” বলেও আখ্যায়িত করে। বর্তমানে তিনি বিশ্বজুড়ে মুক্তচিন্তন ও বাকস্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এমনকি প্রতি বছর রোমে যে স্থানে তাকে পুড়িয়ে মারা হয় তার পাশেই বাৎসরিক স্মৃতিরক্ষাকর অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়।  ব্রুনোর গল্প আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আমাদের চিন্তাভাবনাকে কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উন্মুক্ত রাখা উচিত। প্রতিটি মানুষকে হওয়া উচিত মুক্তচিন্তক কারণ মুক্তচিন্তনই জন্ম দেয় নতুন নতুন সৃষ্টির।  নিজকে মুক্তচিন্তক করে তুলুন , নিজের আসেপাশের মানুষকেও করে তুলুন মুক্তচিন্তক। তবেই এই বিশ্ব হয়ে উঠবে এক উন্মুক্ত উৎকৃষ্ট বাসস্থান!  [ গল্পসুত্র কসমস এবং উইকিপিডিয়া । এই আর্টিকেলে ব্যবহৃত সমস্ত ছবি কসমস সিজন ২ থেকে নেওয়া। কসমস ও ন্যাশনাল গিওগ্রাফি চ্যানেল কে অসংখ্য ধন্যবাদ| Pictures Copyright (C) Cosmos Season 2]
চিন্তা হোক উন্মুক্ত / নাহলে পৃথিবী হয়ে উঠবে বিভক্ত / এবং সাথে সাথে মানুষ হয়ে উঠবে দগ্ধ।  ~ পলাশ বাউরি

✏️ শেষ সম্পাদনাঃ বুধ, 25 জানুয়ারি 2023 | 📎 লিঙ্ক
এক লেখাটি সম্পর্কে কোনো মতামত আছে 🤔? তাহলে আমাকে ইমেল পাঠান (নীচে দেওয়া আছে) কিংবা টুইটারে বা ফেসবুকে আমাকে @bauripalash মেনশন করে পোস্ট করুন 😺!

আমার লেখাগুলো বা অন্যকোনো কাজ ভালো লাগছে? তাহলে এক কাপ চা খাওয়ান

আরও পড়ুন