সমাজ ও দ্বৈততা ত্রুটি

বর্তমানের আধুনিক মানুষের জন্ম প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে। মানুষের জন্মকাল থেকেই বিভিন্ন সংগ্রাম , পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ আজকের এই “আধুনিক” মানুষের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এই লম্বা সফরে আমাদের মানব সমাজে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ গঠেছে। তবে মানব সমাজের সূচনা কাল থেকেই মানুষের মনের গভীরে কিছু ত্রুটিও মিশে রয়ে গেছে - তেমনি একটি ত্রুটি হল দ্বৈততা (Duality) ত্রুটি। 

** **

দ্বৈততা বা Duality জিনিসটা কী?

দ্বৈততার উল্লেখ গণিত, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানে অনেকক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের এখানে আলোচনার বিষয় হল মানুষের মনের অন্তরে থাকা দ্বৈততার। মানুষের মনের দ্বৈততা কিন্তু কিছুটা অদ্ভুত রকমের, আমাদের চিন্তাভাবনা দ্বৈততা দ্বারা আক্রান্ত , ফলে আমরা কাছে সমস্ত বস্তু, শক্তি ও পদার্থকে একটি জোড়ের সমষ্টি বলে মনে হয় । আমাদের কাছে সমস্ত কিছুই একটি মুদ্রা আর তার আছে মাত্র দুটি পিঠ। 

যেমন, তাপমাত্রাকে আমরা শুধু দেখি ঠাণ্ডা বা গরম হিসাবে, কোনো মানুষের বা প্রাণীর চরিত্রকে আমরা দেখি দুভাবে ভালো বা খারাপ, কোনো বস্তুর সৌন্দর্যকে আমরা দেখি সুন্দর বা কুৎসিত হিসাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

আমরা যদি একটু জোর দিয়ে ভাবি তাহলে সবকিছুই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সৃষ্ট। ভালো - খারাপ , ঠাণ্ডা - গরম, আলো-অন্ধকার প্রভৃতি। এখানে প্রতিটি জোড়ার একটি উপাদান ওপর উপাদানের বিপরতি মাত্র। যেমন, ভালো-খারাপ জোড়ের একটি উপদান “ভালো” হল আসলে খারাপের অনুপস্থিতি এবং “খারাপ” হল ভালোর অনুপস্থিতি; ঠাণ্ডা-গরম জোড়ের ঠাণ্ডা হল গরমের অনুপস্থিতি আবার গরম হল ঠাণ্ডার অনুপস্থিতি; আলো-অন্ধকার জোড়ের আলো হল অন্ধকারের অনুপস্থিতি আবার অন্ধকার হল আলোর অনুপস্থিতি। 

 

কিন্তু এই ত্রুটি আমরা নিজেরা তৈরি করিনা, বরং এই ত্রুটি আমার মস্তিষ্কে আগের থেকেই উপস্থিত, যুগের পর যুগ বিবর্তনের পরেও এর বিলুপ্তি হয়নি তার একমাত্র কারণ হল - এর সাহায্যে মস্তিষ্ক সহজে কোনো সিধান্তে উপনীত হতে পারে। আমাদের হাতে বিকল্প যত সীমিত বা কম হবে, সিধান্তে আমরা তত দ্রুত উপনীত হতে পারব।

একটা সহজ উদাহরণ দিলে ব্যপারটা বুঝতে পারবে,ঠিক কেন আমাদের মস্তিষ্ক দ্বৈততাকে ত্রুটিকে বিলুপ্ত হতে দেয়নি। কোন কাজ বা প্রশ্নের সময় যদি একটি বিকল্প তাহলে আমাদের আর বাছাই করার কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু যদি নুন্যতম দুটি বিকল্প থাকে তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের কাছে বিকল্প পছন্দের সুযোগ থাকে, অন্তত একটা সুযোগের ভ্রম থাকে। 

ধরো, তুমি একটি ঘড়ির দোকানে ঘড়ি কিনতে গেলে। সেখানে তোমাকে যদি বলা হয়, আমাদের সব স্টক শেষ হয়ে গেছে মাত্র একটি ঘড়ি পরিশেষ আছে, যদি তোমার কাছে ঘড়ি কেনাটা যদি খুব প্রয়োজনীয় হয় এবং তোমার এলাকায় আর কোন ঘড়ির দোকান না থাকে (এবং অনালাইন কেনার ব্যবস্থাও নেই) তাহলে তোমাকে বাধ্য হয়ে সেই ঘড়িটাই কিনতে হবে। আবার ধরো, তোমার সামনে দুটি ঘড়ি রাখা হলো এবার তোমার কাছে অন্তত কিছু সুযোগ রইল। কিন্তু এবার যদি তোমার সামনে ৫০টি ঘড়ি নামিয়ে দেওয়া হল! এবার স্বাভাবিক ভাবেই তোমার ঘড়ি পছন্দ করতে কিন্তু বেশি সময় লাগবে। এবার ভেবে দেখো যখন তোমাকে দুটি ঘড়ি দেখানো হল, তখনের তুলনায় ৫০টা ঘড়ির ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগবে।  অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবেই, আমাদের মস্তিষ্ক দুটি বিকল্পের দিকে বেশি পক্ষপাতী, কারণ এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের শক্তিখরচও কম হয় এবং পছন্দ করারও সুযোগ থাকে। ঠিক এই কারণেই আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা দ্বৈততা বা Dualism দ্বারা আক্রান্ত। 

 

ত্রুটি একটা আছে বোঝা গেলো, কিন্তু এই ত্রুটির ফলে আমাদের কী অসুবিধা হচ্ছে?

দ্বৈততা ত্রুটির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব হল, এটি আমাদের চিন্তাভাবনা ও কল্পনাকে সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ করে দেয় সাথে সাথে আমার সৃষ্টি ও আবিষ্কারকেও ত্রুটিপূর্ণ করে তোলে। অর্থাৎ ভেবে দেখতে গেলে আমদের এতদিনের সৃষ্টি করা সব তত্ত্ব, চিন্তা ভাবনা, গবেষণা কিন্তু একটু হলেও ত্রুটিপূর্ণ। কিছু অন্যান্য ত্রুটি সাথে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে এই দ্বৈততা ত্রুটি, আমাদের কল্পনাকে সীমিত করে তোলে। ফলে আমাদের জ্ঞান ও ধারনাও সীমিত হয়ে যায়। 

এর কিছু ভালো দিক আছে, আবার খারাপ দিকও আছে - ভালো দিক বলতে, এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কের শক্তিখরচ কম হয়, তাছাড়া কোনো জিনিস সম্পর্কে আমরা দ্রুত সিধান্তে উপনীত হতে পারি ইত্যাদি। আবার সবথেকে বড় অসুবিধা হল, আমাদের চিন্তাভাবনা, কল্পনা সবকিছুর সীমা সীমিত হয়ে যায়!

ধরো রাস্তায় একটা লোকের সাথে তোমার দেখা হলো, হঠাৎ তোমার পাশে এসে তোমার সাথে এসে কথা বলতে শুরু করল সে। প্রথমে হয়তো পরিচয় আদানপ্রদান হলো, তারপর নিজেদের কাজকর্ম, শখ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হল। এতক্ষণে কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক নিজে নিজেই সেই ব্যক্তি সম্পর্কে একটা মানসিক প্রতিকৃতি তৈরি করে নেয়। সেই প্রতিকৃতির বৈশিষ্ট্যও আবার সেই মানুষটির বৈশিষ্ট্য ও বাহ্যিক চরিত্রের অনুরূপ হয়। আবার এবার সেই লোকটি যদি তোমার ফোন নম্বর খুঁজে এবার তুমি তোমার মানসিক প্রতিকৃতি থেকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে, লোকটি ভালো কি খারাপ? লোকটিকে কি ফোন নম্বর দেওয়া যায়? এভাবে আমাদের মস্তিষ্ক লোকটি সম্পর্কে ধারনা সৃষ্টি করে।

অনেকে বলে যে, আমাদের কল্পনাশক্তি অসীম কিন্তু এবার তো সহজভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের কল্পনাশক্তি ও চিন্তাভাবনা সসীম ও ত্রুটিপূর্ণ। তাহলে এবার স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কিভাবে তাহলে আমরা এই ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে পারি এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে পারি? 

এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এত সহজ নয়, এবং সংক্ষেপে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাবে না। এই ত্রুটি দূরীকরণের জন্য, আমাদের প্রথমে ত্রুটি সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার ছিল; এতকাল আমাদের এই ত্রুটি সম্পর্কে ধারনা কম থাকার কারণেও এই ত্রুটিকে আমরা ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারিনি। এই নিবন্ধের মাধ্যমে আমি সেইটুকুই করার চেষ্টা করেছি; এই ত্রুটি কি,কেন,কিভাবে। পরের দিন আবার আলোচনাতে এই ত্রুটি দূরীকরণের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।  

 

[প্রথম
ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে;Infinity ছবিটি FreePik থেকে]

ইতিহাস আজ রুদ্ধ / বিবর্তন আজ স্তব্ধ / মানুষের ত্রুটিগুলো মাথা চাড়া দেয় আজ / ধ্বংস বিলাপের লক্ষ্যে

~ পলাশ বাউরি

✏️ শেষ সম্পাদনাঃ বুধ, 25 জানুয়ারি 2023 | 📎 লিঙ্ক
এক লেখাটি সম্পর্কে কোনো মতামত আছে 🤔? তাহলে আমাকে ইমেল পাঠান (নীচে দেওয়া আছে) কিংবা টুইটারে বা ফেসবুকে আমাকে @bauripalash মেনশন করে পোস্ট করুন 😺!

আমার লেখাগুলো বা অন্যকোনো কাজ ভালো লাগছে? তাহলে এক কাপ চা খাওয়ান

আরও পড়ুন