সমাজ ও সহশিক্ষা

আমাদের সমাজ সংস্থার এমন কিছু কিছু দিক আছে সমাজ ও মানুষের ওপর এত সূক্ষ্মভাবে প্রভাব বিস্তার করে তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার অনেক সময় হয়তো চোখে পড়লেও আমরা সেই বিষয়ে নাক গলাতে চাইনা এইভাবে যে আমাদের সেই ব্যাপারে মাথা ঘামানোর ফলে কোনো ধনাত্মক প্রভাব তো পড়বে না বরং ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। তাই বলে কি হাতে হাত রেখে বসে থাকবো? 

 

না! কখনই না! বর্তমান সময় একটি ভয়ংকর সন্ধিক্ষণ , আমার ভাষায় যাকে বলে “প্রাক-পরিবর্তনের সময়কাল”। এইসময় নানান ধরনের প্রভাবকের উৎপত্তি হবে, যা আমাদের সমাজকে এক নব সমাজের দিকে পরিবর্তনের গতিকে তরান্বিত করবে। তেমনি একটি জিনিস নিয়ে আজ আলোচনা করবো, যাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সমাজের লিঙ্গবৈষম্য অনেকটা হলেও দূরীকরণ হওয়ার পুরো-পুরো সম্ভাবনা আছে - 

সহশিক্ষা বা ইংরেজিতে Co-Education, হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের একটি ব্যবস্থা। সহশিক্ষার অভিধানগত অর্থ বলা যায় - একই প্রতিষ্ঠানে একই শ্রেণীকক্ষে একই সময়ে একই শিক্ষক/শিক্ষিকা দ্বারা একই শাসনব্যবস্থার অন্তর্গত হয়ে একই পাঠক্রমের শিক্ষাদানকে সহশিক্ষা বলে। [ সূত্র ]

অর্থাৎ সহজ কথায় বলতে গেলে সহশিক্ষায় ছেলে মেয়ে বা অন্য কোনো লিঙ্গের শিক্ষার্থী একসাথে শিক্ষাগ্রহণ করবে। প্রথম শোনায়, অনেকের মনে অনেকরকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে - সে হতে পারে ইতিবাচক কিম্বা নেতিবাচক! যাইহোক, যেহেতু বিষয়টি আমাদের সমাজ পরিবর্তনের রথের সারথি ছাত্র যুবদের বিষয়ে তাই এখানে আমি খারাপ ভালো দুটি দিকই আলোচনা করার চেষ্টা করবো এবং বোঝার চেষ্টা করবো যে সহশিক্ষা সমাজের পক্ষে ভালো না খারাপ? 

প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষার কয়েকটি ইতবাচক দিক দেখে নেওয়া যাক - 

সহশিক্ষা কমবয়স থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে সব লিঙ্গের মানুষের প্রতি সম্মান ও সমতার মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মনে পারস্পরিক সহানুভুতি ও বোঝাপড়ার সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী জীবনে তাদের আদর্শ মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

সহশিক্ষা সহপাঠীদের মধ্যে এক সুস্থ প্রতিযোগিতারও পরিবেশ তৈরি করে। সুস্থ প্রতিযোগিতা যেমন তাদের পঠনপাঠনের প্রতি আরও উৎসাহিত করে সফলতার জন্য মনোভাবের সৃষ্টি করে তেমনই পরাজয়ের ব্যথা সামলাতেও প্রস্তুত করে। বিপরীত লিঙ্গের সাথে সুস্থ প্রতিযোগিতা পরিবর্তীকালে জীবনে বিপরীতলিঙ্গের গুরুত্ব বুঝতেও সাহায্য করে। 

এইসব ছাড়াও, সহশিক্ষা এক সুস্থ ও সমতার পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা বিপরীতলিঙ্গকে সমান চোখে দেখতে শিক্ষার্থীদের শেখায়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে দানা বাঁধা অন্য লিঙ্গের প্রতি সুপ্ত ভয়কে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। তাদের বোধগম্য হয় যে ওপর লিঙ্গের মানুষেরা কোনো ভিনগ্রহী প্রাণী নয় বরং তারাও আমাদের মতোই সাধারণ রক্ত মাংসের মানুষ। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এই সুপ্ত ভয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে জন্ম দিতে পারে সুপ্ত উদ্ভট মানুষিকতার যার ফলস্বরূপ সমাজে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ! 

 

এসব ঠিক আছে, কিন্তু কেও কেও যুক্তি দিতে পারে, 

সব লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রেখে পাঠদান করলে, তাদের কৈশোর বয়সে পাঠগ্রহনে মন সংযোগের প্রতি ব্যঘাত ঘটতে পারে। 

কিম্বা কেও বলতে পারে, ছেলে মেয়ে একই শিক্ষাকেন্দ্রে পড়লে, তাদের মধ্যে প্রেম-পরিণয়ের সূত্রপাত হতে পারে, যা তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। 

বা, এও কেও বলতে পারে, এই সহশিক্ষার ফলে, শিক্ষাকেন্দ্রের ভেতর অনৈতিক কার্যকলাপ হতে পারে। অথবা, বিপরীত লিঙ্গের মনে অযৌক্তিক বাগ-বিতণ্ডার ফলে এক শিক্ষাদানের জন্য অসুস্থ পরিবেশের সৃষ্টি হতে পারে… ইত্যাদি ইত্যাদি

[আরও কিছু নেতিবাচক মন্তব্য থাকলে, নামে বেনামে কমেন্ট করতে পারো]

এবার আমার উত্তর এইসব নেতিবাচক মন্তব্যের প্রতি - 

প্রথম মন্তব্যের উদ্দেশ্যে বলি, কিশোর বয়স এমন একটি জটিল বয়স, যখন ছেলে মেয়ে উভয়ের মনে ও শরীরে নানা ভাংচুর হতে থাকে। মানুষের যৌনতার প্রতি তারা আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ হওয়া এইসময় খুবই স্বাভাবিক, প্রতিটি মানুষই এই সময়টা তার নিজের জীবনে অতিক্রম করেছে। বুঝলাম, সহশিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনযোগের ব্যঘাত ঘটতে পারে, কিন্তু তা তো রোজকার জীবনেও যখন তখন ঘটতে পারে। তাহলে তো কিশোরকিশোরীদের ঘর থেকে বেরতে দেওয়া চলবে না , আর তাদের চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখতে হবে, নাহলে যখন তখন তো বিপরীত লিঙ্গের মানুষ তাদের সামনে চলে আসতে পারে আর তাদের বিভ্রম ঘটতে পারে!? 

দ্বিতীয় মন্তব্যের উত্তরে বলি, প্রেম ভালবাসা তো রাস্তা ঘাটেও হতে পারে , তাহলে তো শিক্ষার্থীদের ঘর থেকে বেরোনো আজই বন্ধ করে দিতে হবে! আর তারা কি ভুলে যাচ্ছেন যে, প্রেম তো শুধু ছেলে মেয়ে ছাড়াও ছেলে ছেলে বা মেয়ে মেয়েতেও তো হতে পারে। তাহলে সবরকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দিতে হবে।

তৃতীয় ও চতুর্থ যুক্তির ঘটনা তো শিক্ষাকেন্দ্রের বাইরেও ঘটতে পারে, তখন কি করবে বন্ধুগন? 

এতক্ষণ আলোচনাতে আমরা কি এমন শক্তিশালী ব্যখা পেলাম যে সহশিক্ষা আমাদের সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর? নাহ! বরং এতক্ষণ আমরা এটা বুঝতে পারলাম সহশিক্ষা আমাদের সমাজের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা শুনলে অবাক হতে পারো, দিল্লি সরকার তাদের সমস্ত শুধুমাত্র ছেলে বা মেয়েদের জন্য সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে সহশিক্ষা বিদ্যালয়ে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ তারা দেখছে সমস্ত বড় পরীক্ষাগুলিতে সহশিক্ষা বিদ্যালয়গুলির পাশের হার সবচেয়ে বেশি। [ সূত্র ]

এবার আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমাদের বিদ্যালয়ে কিভাবে সহশিক্ষার নামে কিভাবে একটি উদ্ভট ব্যবস্থার সূচনা করেছিল (বিশ্বস্ত সুত্রে খবর যা এখনো বর্তমান)। 

আমি যখন ২০১১ সালে প্রথমে মঙ্গলদা বি.এন.জে. উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (সরকারি ও সহশিক্ষা বিদ্যালয়) ভর্তি হলাম, তখন থেকেই নতুন নিয়ম হলো যে সমস্ত মেয়েরা থাকবে “ক”/A বিভাগে এবং সমস্ত ছেলেরা থাকবে “খ”/B বিভাগে। কি উদ্ভট নিয়ম! বেশ কয়েকবছর এমনই চলল! তবে একটি ভালো দিক ছিল যে, ছেলে মেয়েদের একই শ্রেণিকক্ষে বসানো হতো। কিন্তু ক্লাসটা তখন ঠিক মনে নেয়, হয়তো সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি হবে, সেই সময় আবার নতুন নিয়ম করল স্কুল কর্তৃপক্ষ, মেয়েরা থাকবে A ও B বিভাগে এবং ছেলেরা থাকবে C ও D বিভাগে এবং ছেলেরা ও মেয়েরা বসবে আলাদা আলাদা শ্রেণীকক্ষে। কি উদ্ভট নিয়ম, এতো সহশিক্ষার নীতির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ, তাই নয় কি? তখন থেকেই আমার মনে একটা সুপ্ত ক্ষোভ ছিলই কিন্তু দুঃখের কথা সেই সময় কিছুই করতে পারিনি! শেষমেশ কয়েকমাস আগে ঠিক করলাম, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লেখব এই বিষয়ে, আমার অনুমান ছিল যেহেতু আমারা স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নতুন প্রধান শিক্ষক এসেছেন তাই হয়তো তিনি এবিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হবেন। কিন্তু আমার সে পরিকল্পনাও নানা কারণে ভেস্তে গেছে! 

আমি ঠিক জানিনা, কী মনে করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারা হয়তো নেতিবাচক দিকগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বিবেচনার সময়। কিন্তু আলাদা রেখেও তো আমাদের সব বন্ধুরা প্রেমও করেছি, আবার স্কুলে ঝামেলাও হয়েছে! তাহলে লাভের লাভ কি হলো? 

 

আমার মতে সহশিক্ষা বর্তমান সমাজের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! এর ফলে শিক্ষার্থীগন ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়, শুধুমাত্র ছেলে বা মেয়ের বিদ্যালয়ে পড়লে তাদের মধ্যে অন্য লিঙ্গের পক্ষে তেমন কোনো সম্যক ধারনা তৈরি হয় না, ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র জীবন ব্যহত পারে। 

[সব ছবি Freepik থেকে]

ছেলে মেয়ে পড়বে গড়বে একসাথে / বানাবে নতুন সুন্দর বিশ্ব

~ পলাশ বাউরি

✏️ শেষ সম্পাদনাঃ বুধ, 25 জানুয়ারি 2023 | 📎 লিঙ্ক
এক লেখাটি সম্পর্কে কোনো মতামত আছে 🤔? তাহলে আমাকে ইমেল পাঠান (নীচে দেওয়া আছে) কিংবা টুইটারে বা ফেসবুকে আমাকে @bauripalash মেনশন করে পোস্ট করুন 😺!

আমার লেখাগুলো বা অন্যকোনো কাজ ভালো লাগছে? তাহলে এক কাপ চা খাওয়ান

আরও পড়ুন