স্বীকৃতি
** ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের** নাম শুনেছো? শুনলে ভালো , না শুনলেও খুব একটা অবাক হবো না। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ডাক্তার এবং গবেষক। তিনি ভারতের প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবির স্রস্টা বা পথিকৃৎ। কিন্তু তার এই যাত্রা এত সহজ ছিল না। আমাদের মানুষের সহজাত কিন্তু খারাপ স্বভাব হলো অন্যের সাফল্যকে ছোট করে দেখানো এবং তাকে পিছনে টেনে আনা। একইভাবে সুভাষবাবুও সারাজীবন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা।
গতকাল জন্মদিন ছিল এই মহান ব্যাক্তিটির , কিন্তু কজন মনে রেখেছেন তাঁকে!?
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি , তৎকালীন বিহারের হাজারিবাগ শহরে জন্মগ্রহন করেন তিনি। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. পাস করেন, ওই বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকও হন। তিনি দুটি বিষয়ে পি.এইচ.ডি লাভ করেন যথাক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তিনি দেশে ফিরে এসে , ইংল্যান্ডে প্রথম নল-জাত শিশুর জন্মের মাত্র ৬৭ দিনের মাথায় ভারতে প্রথম নল-জাত শিশুর জন্ম দিয়ে বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেন। এই গবেষণা সম্বন্ধে বিদেশে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চাইলে, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার বিদেশে যাওয়ার আর্জি খারিজ করে দেন। এমনকি তার গবেষণাকে স্বীকৃতিপ্রদান না করেন , তার গবেষণা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে স্বাস্থ্যদপ্তর একটি কমিটি গঠন করে গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করার জন্য। এই সবকিছুর কারণ ছিল, তার সহকর্মীদের এবং কিছু সরকারি কর্মীদের ঈর্ষান্বিত মানসিকতা । দুঃখের কথা, কমিটির পর্যালোচনা শেষে তার সমস্ত গবেষণাকে মিথ্যা বলে রায় দেয় কমিটি। এবং শাস্তিস্বরূপ তাঁকে বাঁকুড়াতে এক প্রতিষ্ঠানের চক্ষু বিভাগে বদলি করে দেওয়া হয়, এবং যাতে তিনি গবেষণার সুযোগ না পান তারও ব্যবস্থা করা হয়। [সূত্র] তিনি আক্রান্ত হন হৃদরোগে। যদিও পরে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায়। কিন্তু ছলে বলে কৌশলে ছিনিয়ে নেওয়া হয় গবেষণা করার সমস্ত সুবিধা। তাকে অফিস দেওয়া হয় চারতলায় , একজন হৃদরোগীর পক্ষে রোজ এতগুলো সিঁড়িভাঙ্গা যে কতটা বিপজ্জনক তা আজ বাচ্চাকাচ্চারাও বোঝে। এরপরেও সরকারের আমলাতান্ত্রিকতা এবং চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিক সমাজের ক্রমাগত বিদ্রূপ ও অপমানে হতাশ হয়ে এই মহান মানুষটি শেষমেশ বেছে নেন আত্মহননের পথ।
তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয় , ভারত সরকার স্বীকৃত এবং ডাঃ টি সি আনন্দ কুমার পরিচালিত টেস্টটিউব শিশু হর্ষ। ডাঃ আনন্দ কুমার, এক জাতীয় বিজ্ঞান অধিবেশন উপলক্ষে কলকাতায় এলে তার হাতে আসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার নথিপত্র। এই নথিগুলি যাচাই করে এবং দুর্গার মা বাবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন যে, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই হলেন ভারতের প্রথম নল-জাত শিশুর স্রস্টা। এসব কথা তিনি সংবাদমাধ্যমে প্রচার করেন।
২০০২ তে গঠন করা হয় ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি এবং অবশেষে ২০০৩ সালে স্বীকৃতি পায় ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা। কানুপ্রিয়া আগরওয়ালা ওরফে দুর্গাও তার ২৫ বছরের নীরবতা ভেঙ্গে , এক স্মৃতিসভায় নিজেকে জনসমক্ষে এনে বলে যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা মিথ্যা ছিল না। বর্তমানে সে দিল্লীর গুরগাঁওতে কর্মরত।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে তপন সিনহা একটি হিন্দি সিনেমা তৈরি করেন , “এক ডক্টর কি মওত”। তার জীবন নিয়ে একটি উপন্যাসও লেখা হয় , “অভিমন্যু”।
বিজ্ঞানীরা তাদের নামে নয় , মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকেন তাদের কাজের মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের কথা আমাদের যুব সমাজ এই মহান বিজ্ঞানীকে একেবারে ভুলেই গেছে। ২০১০ সালে চিকিৎসাক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার পান ডঃ রবার্ট এডওয়ার্ডস প্রথম নল-জাত বেবির স্রষ্টা হিসাবে, হয়তো সেদিন তার সাথে আমাদের ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও নোবেল পেতে পারতেন।
কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের অপরিমেয় ঈর্ষা এবং নিরন্তর দুর্ব্যবহার ও অপমান, এই প্রতিভাবান মানুষটির মেধাকে দুমড়ে মুচড়ে মেরুদণ্ডহীন করে দিয়েছিল। শেষমেশ লোকসান হল , আমাদের নিজেদেরই । আরও দুঃখের কথা একটা ছবি ছাড়া আর কোনো ছবি নেই ইন্টারনেট পাড়ায়।
সুভাষ নামটাই দুর্ভাগা / এই নামের কেউই পেলেন না সুবিচার
~ পলাশ বাউরি