সমাজ ও শিক্ষা
শিক্ষা সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। শিক্ষা ছাড়া সমাজের পরিবর্তন বা অগ্রগতি কোনটাই সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষা বলতে শুধু তাত্ত্বিকজ্ঞানকেই শিক্ষা বলা চলে না, শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয় - যদি তা হয় তাহলে সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, তাকে বরং ছদ্মশিক্ষা বলা চলে এবং এই শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের ছদ্মশিক্ষিত বলা চলে। যতক্ষণ না শিক্ষার মধ্যে সমাজে বা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কিছু সাধারণ কলা কৌশল না শেখানো হয় ততক্ষণ তাকে সম্পূর্ণ শিক্ষা বলা চলে না।
সেই অর্থে বলা চলে, আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলিতে যে শিক্ষাদান করা হয়, সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যে বিষয়গুলি অতিশীঘ্রই সংযুক্ত করা উচিত সেগুলি হল - শিক্ষার গুরুত্ব, যৌন শিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষা, নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করার শিক্ষা, প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা, সমতার শিক্ষা এছাড়া একজন শিশু বড় হয়ে যা যা সমস্যার বা নতুন কিছুর সম্মুখীন হতে পারে তার শিক্ষাও প্রদান করা উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে।
যেকোনো একটা স্কুল যাওয়া বাচ্চাকে ধরে জিজ্ঞেস করা হয় , তোমার স্কুল যেতে কেমন লাগে? মুখে যা কিছুই বলুক, মনে মনে বেশিরভাগই বলবে, স্কুল যেতে ভালো লাগে না। তারা স্কুল যায় ঘরের চাপে কিম্বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হয় বলেই। কিন্তু কেন শিক্ষার্থীদের স্কুল যেতে ভালো লাগে না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ কি তাদের উপযোগী নয়?
সব উত্তর খোঁজার আগে, আমাদের খুঁজে বার করতে হবে, স্কুল বা অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য কী? শুধুমাত্র কি শিক্ষার্থীকে চাকরি পেতে সাহায্য করা বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করা? [সমাজ প্রতিষ্ঠিত বলতে তো আমরা এখন তাদেরই বুঝি যাদের টাকা ও পরিচিতি আছে] আমার মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির একটি সাধারণ উদ্দেশ্য আছে, শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করা! যেহেতু আমরা “শিক্ষিত” শব্দের অর্থটিই ভুল বুঝেছি সেহেতু এতসব সমস্যার সূত্রপাত। আমাদের বর্তমান “শিক্ষিত” মানুষের সংজ্ঞাটাই ভুল। গোঁড়াতেই গণ্ডগোল!
শিক্ষিত মানুষ কাকে বলে? যার শিক্ষা আছে তাকেই শিক্ষিত বলা চলে। এবার তাহলে প্রশ্ন আসবে শিক্ষা কাকে বলে? আমার মতে শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা আমাদের অন্তর্নিহিত গুনগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং সমাজে আমাদের জীবনকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সহজ কথায় বলা যায় - জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করাকেই শিক্ষা বলে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের “মানুষ” করে তোলা। তবে এখানেও একটা বিরাট জটিল দার্শনিক প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয় - “আদর্শ” মানুষ কে? সে নিয়ে নানা মুনির না না মত আছে, আমি এ নিয়ে আজ আলোচনায় যেতে চাই না। বিভিন্ন দেশে আধুনিক শিক্ষার সূচনা হয়েছিল বিভিন্ন কারণে, তবে আমাদের দেশে সূচনা হয়েছিল ইংরেজদের জন্য সুযোগ্য চাকুরীজীবী তৈরির জন্য কিন্তু আমার বোধগম্য হয়না যেখানে অন্যান্য দেশ শিক্ষা ব্যবস্থায় এত আমূল পরিবর্তন আনছে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশ এখনো কেনো সেই ইংরেজ আমলের ব্যবস্থাকেই ধরে রেখেছে, হয়তো সরকারও চায়না ছাত্রযুব সমাজ সঠিক ভাবে শিক্ষিত হোক - তারা হয়তো চাই ছাত্রযুব সমাজ শুধু যাতে চাকুরীজীবিই তৈরি হয়। এ নিয়ে আরও বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন আছে।
শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সাথে পরীক্ষা ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। পরীক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থী নিজের ত্রুটি বুঝতে পারে, কিভাবে নিজেকে আরও উন্নত করা যায় সেও বুঝতে পারে। তার বদলে আজকে কী হচ্ছে? ঝুড়ি ঝুড়ি লাইন লাইন মুখস্ত করো আর পরীক্ষার সময় তা গিয়ে উগরে দাও! আজকালের তথাকথিত পরীক্ষাতে শিক্ষার্থীর মেধা বা যোগ্যতার বদলে যাচাই করা হয় শুধু মনে রাখার ক্ষমতা!
আসলে যে সময়কালে এই পরীক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল সেইসময় বিজ্ঞান এতটা উন্নত ছিল না এবং তথ্য ধরে রাখার কাজ হত মূলত মনে রাখার দ্বারা , কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নত - নানারকম স্টোরেজ যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে। এখন আর মনে রাখা মানুষের কাজ নয় বরং তা যন্ত্রের কাজ।
যখন প্রথম প্রথম মানুষের হাতে মোবাইলফোন এল, তখন মানুষ নিজের সব পরিচিতদের ফোন নম্বর মুখস্ত করে রাখত বা খাতায় লিখে রাখত, কিন্তু এখন? অনেক মানুষ তো নিজের নম্বরটাই মনে করে বলতে পারবেন না - ফোন খুলে দেখে দেখে বলবেন। এত কম সময়ে এত পরিবর্তনের কারণ কিন্তু সেই প্রযুক্তিই!
পরীক্ষাতে যদি সৃজনশীলতা ব্যবহার করে যদি অভিনব সব উপায়ে শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা , উপস্থিত বুদ্ধি , এবং জ্ঞান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা যায় তবেই সেই পরীক্ষা পদ্ধতি সফল হবে।
শিক্ষা পদ্ধতিতেও মুখস্ত করার বদলে নতুন নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে এবং শীঘ্রই শিক্ষার গুরুত্ব , যৌন শিক্ষা পাঠক্রমের অন্তর্গত করা উচিত। তারপর বর্তমানে পাঠরত শিক্ষার্থীদের উপর বিরূপ প্রভাব না ফেলে সাবধানে কিন্তু দ্রুত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো উচিত। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত গুনগুলির ব্যপ্তি ঘটানোতে গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সব শিক্ষার্থী কিন্তু আলাদা তার অর্জন করার ক্ষমতাও আলাদা। এবার যদি কেউ বাঁদর আর মাছের প্রতিযোগিতা করে কে আগে গাছে চাপতে পারে তাহলে সে তো মাছের প্রতি অন্যায় হয়। তাই শিক্ষার্থী ভেদে আলাদা ** ব্যক্তিগতকৃত ** শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি বিকেন্দ্রীভূত করা যায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে , ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষাদান করা যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের কাছে সুযোগ থাকবে নিজের পছন্দমতো পাঠক্রমবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করার সুবিধা থাকবে।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার যদি পরিবর্তন না করা হয় তবে তা হবে সমাজ সংস্থার পতনের অন্যতম অনুঘটক হবে। শিক্ষাই নির্ণয় করে সমাজের ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
শিক্ষা হোক সবার জন্য/ সবার উদ্দেশ্যে
~ পলাশ বাউরি