সমাজ ও পরিবার
কয়েকজন মানুষ নিয়ে একটি পরিবার; কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি সমাজ। যদিও পরিবারহীন সমাজও বর্তমান থাকতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ তথাকথিত সমাজগুলি পরিবার নিয়েই গঠিত হয়। বর্তমান পরিবারব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে নতুন সমাজ সংস্থায়, তার আভাস আমরা পেতে শুরু করেছি এই শতাব্দী শুরুর বেশ আগে থেকেই। আজ আমরা এখানে এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো, কিভাবে পরিবারব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে এবং তার ফলে সমাজ ও মানবজীবনে তার কিরূপ প্রভাব পড়ছে।
এই একবিংশ শতাব্দী শুরুর আগে থেকেই আমরা দেখছি, বৃহৎ পরিবারগুলি ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু-পরিবার সৃষ্টি হচ্ছে। তার ফলে অনেক বিরূপ পড়েছে সমাজে; যেমন - বাসস্থানের চাহিদা বৃদ্ধি, বাজারে জিনিসপত্রের অধিক চাহিদা বৃদ্ধি, শিশুদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপ্তি কম হওয়া, একাকীত্ব ও অবসাদে আক্রান্তে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার উপরোক্ত দফাগুলি বিস্তারিত আলোচনা করলে, ব্যপারগুলি আরও সহজভাবে বোঝাযাবে -
১। বাসস্থানের চাহিদা বৃদ্ধি: প্রথমে চলো একটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। ধরো, লালুবাবুর দুই ছেলে, রমেশ ও সুরেশ। লালুবাবুর একটি বড় বাড়ি আছে ৪ ডেসিমিল জমির উপর এবং সেই বাড়িতে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে বাস করেন। এবার ধরো, তাঁর দুই ছেলে চাকরি পেল, বিয়ে করলো এবং তাদের একটি করে সন্তান্ হল; এবার তারা বিভিন্ন কারণে ঠিক করলো যে তারা আর তাদের বাবা-মায়ের সাথে থাকবে না, তারা তাদের স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আলাদা বাড়িতে থাকবে। এবার স্বাভাবিকভাবেই যদি তাদের নিজের বাড়ি তৈরি করতে হয় তাহলে তাদেরও জমি কিনতে হবে; ধরে নিলাম দুইভাই ৪ ডেসিমিল করে জমি কিনল এবং বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করলো।
এবার ভেবে দেখো, উপরের উদাহরণটিতে যেখানে একটি ৪ ডেসিমিল জমিতে ৮ জনের পুরো পরিবার বাস করতে পারত, সেখানে এখন ১২ ডেসিমিল জমিতে তারা বাস করে। এবার সহজেই বুঝতে পারছ কিভাবে পরিবারগুলি ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে বাসস্থানের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এবার যদি, ভাবো তারা যদি নিজের বাড়ি তৈরি করার ফলে ফ্ল্যটে বসবাস করে তাহলে এই সমস্যা তৈরি হবেনা। কিন্তু না, সমস্যার সমাধান হিসাবে পূর্বেই জমি ক্রয় করে ফ্ল্যাট তৈরি করে রাখা হয়েছে; এক্ষেত্রে সমস্যা অতটা দৃষ্টিগোচর হয়না বলে আমরা ভাবি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে কিন্তু না, এই বাসস্থানের সমস্যা পৃথিবীর বুকে একটি জ্বলন্ত সমস্যা।
তবে শুধু পরিবার ভাঙ্গনের জন্যই বাসস্থানের চাহিদা বৃদ্ধি পায়না, এটি একটি অন্যতম কারণ হলেও অত্যাধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি এর আরেকটি বড় কারণ।
২। বাজারে জিনিসপত্রের অধিক চাহিদা বৃদ্ধি: উপরের উদাহরণটা ধরেই চলি, আগে যখন লালুবাবুর বাড়িতেই সবাই একসঙ্গে বাস করতো তখন তো কিছু কিছু জিনিস একটা করে হলেই চলতো, সেই জিনিসগুলি একটা পরিবারে একটি করেই যথেষ্ট; যেমন - একটি টেলিভিশন (খুব বেশি হলে দুটি; তার বেশি থাকলে বলতেই হল লালুবাবুর অত্যাধিক খরচ করার বদগুণ আছে), একটি উনুন, একটি চারচাকা গাড়ি, একটি ফ্রিজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আবার যখনই, পরিবারটি বিভক্ত হয়ে যাবে তখন তাদের এইসব জিনিসগুলি নতুন করে কিনতে হবে। অর্থাৎ বাজারে বেশ কিছু জিনিসপত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। আবার যদি সেই পণ্যগুলির যথেষ্ট উৎপাদন না হয় তাহলে, মূল্যবৃদ্ধিও হবে।
৩। শিশুদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপ্তি কম হওয়া: যদি শিশুরা জন্ম থেকেই বেশি বেশি মানুষের সান্নিধ্যে থাকে তবে তাদের মানসিকতা সাধারণত উদার ধরনের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে আবার যদি শিশুটি মাত্র একটি বা দুটি মানুষের সান্নিধ্যে বড় হয় তাহলে তাদের মানসিকতা সঙ্কীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে মনে রাখা দরকার ব্যতিক্রম অবশ্যই বর্তমান। তাছাড়া অনেক মানুষ যদি শিশুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশে থাকে সেক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার বেশি হয়।
শিশুর মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপ্তি বেশি হলে, শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনে মানসিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির প্রবণতা বেশি থাকে।
৪। একাকীত্ব ও অবসাদে আক্রান্তে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি: মানুষ সামাজিক জীব এবং মানুষ বেশিসময় ধরে একা থাকতে পারে না; থাকলে মানুষের বিভিন্ন রকমের মানুষিক, দৈহিক, অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। যখন মানুষ বেশি মানুষের সান্নিধ্যে থাকে তার মানসিক অবস্থা ভালো থাকে; তার মনও উৎফুল্লও থাকে। অন্যদিক বেশিসময় একা একা জীবনযাপন করলে একাকীত্ব ও অবসাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এক্ষেত্রে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়, কারণ তাদের চোখের সামনে থাকে শুধু মা ও বাবা। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবা সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়, শিশুটি তখন ঘুম থেকে পর্যন্ত উঠেনি। আবার রাত্রে যখন তারা অফিস বা পার্টি শেষে বাড়ি ফিরে আসেন দেখা যায় শিশু ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন শিশুর সাথে মা-বাবার দেখা নেই, শিশু বড় হয় কাজের মাসির হাতে ফলে শিশুর উপর নানান বিরূপ প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে যদি তারা যৌথ পরিবারে বাস করত তাহলে, শিশুটি কোনো না কোনো পরিবারের মানুষের সান্নিধ্য সারাদিন পেতই। আমি এখানে বলছিনা, ছেলের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তার বাবা-মা তাদের চাকরি ছেড়ে দেক; কিন্তু শিশু তো তাদেরই সন্তান! সন্তানের সুস্থ জীবনের জন্য কিছু ত্যাগ করতেই হয়; জীবনে সবকিছু একসঙ্গে পাওয়া যায় না। বাবা কিংবা মা কাউকে সামান্য ত্যাগ মেনে নেওয়াই উচিত।
এবার ভেবে দেখলে বোঝা যায়, বড় পরিবার ভেঙ্গে ছোট ছোট পরিবার সৃষ্টির ফলে আমাদের নানান অসুবিধার সৃষ্টি হয়। বর্তমান সমাজ সংস্থায় যৌথ পরিবার ভেঙ্গে ছোট পরিবার সৃষ্টি করা এখন একটা “ট্রেন্ড” হয়ে গেছে; অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগুলি হয় অনেকটা সুপ্ত ভাবে হয় ফলে বেশিরভাগ প্রভাবগুলিই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না। তবে সবক্ষেত্রে যৌথ পরিবার ভাঙ্গাটা পরিবারের সদস্যরা নিজের ইচ্ছায় করে না, হয় অনেকটা বাধ্য হয়ে। যেমন তা হতে পারে, বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব অনেক বেশি, বাড়ির মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব বা ঝামেলা, মনমালিন্য ইত্যাদি।
পরিবার ভাঙ্গার এই ট্রেন্ডে সবচেয়ে লাভবান হয় পুঁজিপতিরা। একটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় এই ছোট ছোট পরিবার তৈরি করারটা কিন্তু বেশি প্রচলন পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে, অর্থাৎ পুঁজিবাদের চারণভূমিতে। বর্তমানে এর ছোঁয়া লেগেছে আমাদের প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও।
আমার মনে হয়, সমাজে সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক; কিন্তু এর সমাধান করা প্রয়োজন। আর সমস্যা সমাধানের পথে প্রথম পদক্ষেপ হল, সমস্যার অস্তিত্বকে স্বীকার করা। আমরা এই ট্রেন্ডকে না ভাঙতে সক্ষম হতে পারে, কিন্তু এই ট্রেন্ডের গতিকে স্তিমিত করতে পারি বেশ কিছু কুশলী সিদ্ধান্ত নিয়ে।
[দ্বিতীয় ছবি বাদে সব ছবি Freepik
থেকে]
সমাজ আজ বিভক্ত / বিভক্ত আজ মানুষের মন
~ পলাশ বাউরি