২০২২ -এর সমাপ্তি
বাস আর একদিন তারপরই ২০২২ -এর দিন শেষ। এবছরটা বেশ “হইচই” সমৃদ্ধ ছিল। নতুন নতুন আবিষ্কার, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন মাথা ব্যাথার জন্ম দিয়েছে এই বছর।
করোনা অতিমারী
প্রথমে করোনা নিয়ে কথা বলা যাক, ২০১৯ থেকে এমন যে অতিমারি শুরু হয়েছে যা আর আমাদের পিছু ছাড়ছে না। এবছর যেই সবকিছু একটু একটু ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে সেই আবার করোনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। দেখা যাচ্ছে সাধারনত বছরের এই সময়কালেই করোনার প্রত্যাবর্তন ঘটছে। যেন ব্ল্যাক প্যান্থার সিনেমার সেই ডায়লগ “As You can See I am not dead”।
করোনাকে একটা বৃদ্ধ কচ্ছপের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, একটু বেগতিক বুঝেছে কিনা সেই নিজের খোলের ভিতর ঢুকে যায় আবার কিছুক্ষন পর মাথা বার করে।
সামাজিক মাধ্যম
এবছর সামাজিক মাধ্যমেও বেশ হইহুল্লোড় চলেছে, বিশেষত ওই “কাঁচা বাদাম” গান। Instant Hit তারপরে সবাই ভুলে গেল। এই গানের সুবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গ সাময়িক নাম কামিয়ে আবার ফানুস হয়ে উড়ে গেছেন। তারপর এলো “বাচপান কা পেয়ার” গান খ্যাত ছত্তিশগড়ের এক দশ বছরের ছেলে, এও Instant Hit, বলিউডের এক সংগীত শিল্পী তাকে নিয়ে গান বানালেন। তারপর আগের মতোই সব হাওয়ায় মিশে গেলো। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়াটাও একটা গিমিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, হঠাৎ হঠাৎ ভাইরাল হচ্ছে আবার কিছুদিন পর ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। তবে যে বা যারা ভাইরাল হচ্ছে তাদের থেকেও বেশি ভাইরাল হচ্ছে কিছু “পরজীবী” প্রকৃতির “Social Media Influencer” । এবার প্রশ্ন জাগতে পারে এই “Social Media Influencer” জিনিসটা কি? একেবারে সহজ কথায় বললে, কিছু ব্যক্তি যারা নিজেদের সামাজিক মাধ্যম প্রোফাইলের ক্রিয়া কর্মের দ্বারা অন্যদের উপর Influence বা প্রভাব সৃষ্টি করে।
রাজনীতি
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনোদিন হয়েছে বলে আমার জানা নেই যেখানে সরকারের শিক্ষা দপ্তরের সব উচ্চপদস্থ কর্মীরা জেলে রয়েছে। মেলা খেলাতে না হোক দুর্নীতিতে অন্তত পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ব পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। এর থেকে কলঙ্কের আর কী হতে পারে! এইসব উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং তাদের “পরিচিতদের” বাড়ি থেকে যে পরিমান টাকা উদ্ধার হয়েছে তার ছবি এক ফ্রেমে দেশবাসী আগে দেখেছে বলে মনে হয়না। টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি হয়েছে, যারা চাকরি পাবার “যোগ্য” তারা পায়নি বরং যারা ঘুষ দিয়েছিল তারা চাকরি পেয়েছে।
ব্যাপারটা যখন হাইকোর্ট পর্যন্ত এগোলো তখন হাইকোর্টের নির্দেশনায় CBI তদন্ত শুরু করলো অতঃপর বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য। ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে তাদের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট সাথে সাথে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এতদিন যাবৎ যত টাকা তারা বেতন হিসাবে পেয়েছে তা ফেরৎ দিতে হবে। তাছাড়া যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগও করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্ত এই চাকরি বাতিল ও বেতন ফেরৎ দেওয়া নিয়ে একটা দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, যদি উক্ত “অযোগ্য” ব্যক্তিদের এত বিশাল পরিমান টাকা ফেরত দিতে হয় তাহলে তারা তো এত টাকা দিতে সক্ষম নাও হতে পারে তাছাড়া তারা সমাজের চোখে ছোট হয়ে গিয়েছে এবার যদি তারা আত্মহননের পথ বেছে নেয়? তাহলে কী হবে?
পাপ পাপই! উচ্চ মধ্য নিম্ন বলে সংজ্ঞায়িত করার কোনো সঠিক পদ্ধতি বর্তমান নেই। আমি যা কাজ করি তার পরিণাম আমাকে ভোগ করতেই হবে। যতদিন না আমরা এই ভাঙাচোরা অবৈজ্ঞানিক অবিধেয় পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করছি ততদিন তাহলে এই পরীক্ষা পদ্ধতিকে চরম সত্য বলে ধরে নিতে হয়। আর তা যদি হয় তাহলে যারা টাকা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে তারা অপরাধ করেছে। এই অপরাধের শাস্তি কে কতটা পাবে?
টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া হচ্ছিল বলেই তারা টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছে। পণ্য বর্তমান ছিল বলেই চাহিদা তৈরি হয়েছে নাকি চাহিদা ছিল বলেই পণ্যের জন্ম হয়েছে তা বলা মুশকিল।
বিজ্ঞান বিজ্ঞান গ্রূপের সবথেকে বেশি চর্চায় আছে তা হলে কম্পিউটার বিজ্ঞানের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা AI। বর্তমানে OpenAI নামক এক সংস্থা এবং আরও কয়েকটি গবেষণা থেকে বেশ চমকপ্রদ কয়েকটি জিনিস বাজারে এসেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, DALL-E, GPT3 ও chatGPT এবং Stable Diffusion ইত্যাদি।
DALL-E এবং Stable Diffusion হল এমন একটি AI প্রযুক্তি যার দ্বারা ব্যবহারকারীর প্রদত্ত নির্দেশ অনুসারে ছবি তৈরি করা যায়। যেমন আমি DALL-E কে একটা ছবি বানাতে বললাম “A dolphin typing in laptop, modern art with cartoon asthetics “, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গুটি কতেক ছবি তৈরি করে ফেলল। একটা নমুনা দিলাম -
আবার DALL-E এর একটি দুঃসম্পর্কের ছোট ভাইও আছে যার নাম “Cryaion” (আগে নাম ছিল DALL-E Mini)। এটি DALL-e এর থেকে একটু দুর্বল কিন্তু বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া Stable Diffusion তৈরি করতে পারে Photo Realistic বা তুলনামূলক বেশি বাস্তবতা ঘেঁষা ছবি। একটা নমুনা দিলাম।
অন্যদিকে GPT সিরিজের AI গুলো কোনো প্রদত্ত খন্ড লেখাকে সম্পুর্ন করতে পারে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে, অর্থাৎ যদি একে একটি গল্পের এক লাইন লিখে দেওয়া হয় তাহলে সেটাকে সম্পুর্ন গল্পে রূপান্তরিত করে দিতে পারে এই AI মডেল। GPT এর খুড়তুতো ভাই chatGPT একটু অন্যরকম; এ আবার একটা জলজ্যান্ত মানুষের মতো কথোপকথন চালিয়ে যেতে সক্ষম সাথে সাথে এর সাধ্যের মধ্যে থাকা যেকোনো জিনিস করতে বলা হলে কয়েক সেকেন্ডে সে কাজটি করে ফেলতে পারে।
যেমন আমি যদি একে বলি, খুড়ো একটা প্রকৃতি সম্বন্ধে কবিতা লিখে দাও, মুহূর্তের মধ্যে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের “স্বরচিত” কবিতা আমার সামনে তুলে ধরবে। একটা ছোট্ট নমুনা দিলাম
Nature is a tapestry,
A canvas of living art,
Where beauty and wonder
Are always present, in every part.
তাহলে দেখাই যাচ্ছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা আর বেশিদিন “কৃত্তিম” থাকবে না। ইতিমধ্যে উপরোক্ত জিনিসগুলোর দুর্ব্যবহার শুরু হয়েছে। GPT এর গবেষণা পত্রেও গবেষকরা এবিষয়ে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন, তারা আশা করেছিলেন যে বিষয়ে গবেষণা হবে যাতে করে এই দুর্ব্যবহার আটকানো যায়। কিন্তু কই কিছুই তো তেমন দেখা যায়নি।
কদিন আগে ইন্টারনেটে কারো একজনের নিবন্ধ পড়ছিলাম। সেখানে লেখক বলছেন, আমরা ভেবেছিলাম, সৃজনশীল কাজে AI সবথেকে শেষে প্রভাব বিস্তার করছে কিন্ত এখানে তো সম্পুর্ন ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠছে।
আমার মতে AI যদি এভাবে উন্নত হতে থাকে তাহলে তো দুদিন পরে মানুষের কোনো প্রয়োজনই থাকবে না। লেখক ও শিল্পীদের কাজ সবথেকে আগে যাবে। ধরো কেউ একজন বই লিখছে তার কি দরকার একজন শিল্পীকে দিয়ে বইয়ের অলংকরণ করবার, AI তো কয়েক সেকেন্ডেই সে কাজ করে দিতে পারে। কি দরকার কবির, AI তো কয়েক মুহূর্তেই একটি উৎকৃষ্ট মানের কবিতা লিখে দিতে পারে।
আবার কী দরকার সরকারের? AI তো সুন্দর ভাবে কোথায় কোন খাতে কী খরচ করতে হবে বা কোন প্রকল্পে মানুষের ভালো হবে এইধরনের হিসাব করতে পারে।
আবার স্কুলের যদি কোনো ক্লাসের সিলেবাসের বই তৈরি করতে হয় তাহলে মানব কবি বা শিল্পীর কী প্রয়োজন। AI কে বলে দিলেই তো হলো, “৬ বছরের শিশুর উপযোগী বানান শিক্ষার জন্য যুক্তবর্ন বিহীন এবং পরিবেশে সম্বন্ধীয় ১০ লাইনের একটি ছড়া লিখে দিতে।"। কিংবা “১০ বছরের শিশু উপযোগী বোধ মূলক ও জীবন নীতিযুক্ত ছোট গল্প”। ম্যাজিক! কয়েক সেকেন্ডেই তা তৈরি হয়ে যাবে। আবার এইসবের জন্য অলংকরণও AI তৈরি করে দিতে পারে।
সস্তা (প্রায় বিনামূল্যে), দ্রুত ও আকর্ষণীয় একটি বই তৈরি করা যাবে কয়েক সেকেন্ডেই। তাহলে আর শিল্পী সাহিত্যিকদের কি প্রয়োজন?
বিজ্ঞানীরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত বলতেন, AI শুধুমাত্র সেইসব কাজগুলিই মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে যেগুলো Repetitive বা পুনরাবৃত্তিমূলক। কিন্তু এখন সব গোলমাল হয়ে গেছে।
আমাদের কাছে AI আছে যা সৃজনশীল; সাহিত্য বা শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের কাছে এমন গাড়ি আছে যাতে ড্রাইভার লাগে না যা নিজে নিজেই চলতে পারে। এমন প্রযুক্তির দোকান আছে যেখানে দোকানদারের প্রয়োজন নেই, পছন্দ মতো জিনিস উঠিয়ে নিয়ে যাও, মোবাইলে জিনিসের বিল চলে আসবে।
এইগুলো নিয়ে যদি আমি বছর খানেক আগে কল্পবিজ্ঞানের একটা গল্প লিখে কোনো ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দিতাম, পাঠকদের কাছ থেকে অনেক বাহবা কুড়িয়ে আনতে পারতাম, কিন্ত এখন এটার কল্পবিজ্ঞান তকমার “কল্প” টা উবে গেছে। Science but not a fiction anymore।
যাইহোক আজ বছরের শেষ দিন। সবাইকে আগামীর শুভকামনা। ২০২৩ আমাদের জন্য বরণডালা নিয়ে অপেক্ষা করছে, তবে তার ভেতর থেকে ফুলের সুবাস আসবে নাকি ধ্বংসের হাতছানি তা বোঝা যাবে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ এ। Let’s Enjoy the Show।