আদর্শহীন রাজনীতি
আমি যদি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান হই, ধরি আমার দলের নাম আলুপোস্ত, এবং আমি নির্বাচনে জিতে কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলাম। তাহলে কী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কোনো সাংবাদিক সম্মেলনের সময় আমার রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করা বা আমার দলের হয়ে তরফদারি করা ঠিক?
আমার মনে হয়না তা ঠিক, আমি সেই মুহূর্তে যে বক্তব্য রাখছি সেগুলো হল একজন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, তখন আমি কোনো দলের সদস্য নই, আমার কাছে তখন সব দলই সমান।
আবার যদি আমি কোনো জায়গায় দলের হয়ে সভা করতে যাই, তখন আমি মুখ্যমন্ত্রী নই, তখন আমি শুধুমাত্র আলুপোস্ত দলের নেতা। আমি আমার দলের হয়ে প্রচার করবো, অন্য পার্টির ভুল ত্রুটি তুলে ধরবো, এবং তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে সেইখানে আমার বর্তমান সরকারের ভুল কাজের সমালোচনাও করা উচিত, কারণ সেই মুহূর্তে আমি সরকারের কেউ নই। তবে এখানে একটি সূক্ষ্ম সীমারেখার জন্ম হয়, আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কী কী ভালো কাজ করেছি তার ফিরিস্তি দেওয়া কী ঠিক? আমি তো অন্য দলের তুলনায় অতিরিক্ত সুযোগ পাচ্ছি!
এই জিনিসগুলো, বর্তমানে সমাজে প্রত্যহ দেখতে পাই, মুলত যেসব রাজনৈতিক দলগুলির নিজস্ত কোনো স্বতন্ত্র আদর্শ নেই, যেমন পশ্চিমবঙ্গের তৃনমূল কংগ্রেস কিংবা দিল্লির আম আদমি পার্টি। অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টি বা কমিউনিস্ট দলগুলি যেমন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলির নিজস্ব স্বতন্ত্র আদর্শ ও দর্শন বর্তমান।
আমি যদি আদর্শবাদী কোনো দলের যেকোনো একনিষ্ঠ সদস্যকে জিজ্ঞেস করি তাদের দলের ভবিষ্যৎ দর্শন কী, তারা যদি সঠিক জিনিস নাও বলতে অন্তত একটি সাধারণ ধারনা তারা দিতে পারবে। কিন্তু একটি আদর্শহীন দলের ভবিষ্যৎ দর্শন কী?
একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কী বোঝার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল সেই দলের অভ্যন্তরীণ নিয়মতন্ত্র ও ইস্তেহার পর্যবেক্ষণ করা। চলো কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাকঃ
প্রথমে শুরু করা যাক ভারতের কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা ভারতীয় জনতা পার্টিকে দিয়ে,
তাদের ওয়েবসাইটের থেকে পাওয়া নিয়মতন্ত্রের আর্টিকেল ২ (Objective) -এর প্রথম পরিচ্ছেদেই আমরা পাই
The Party is pledged to build up India as a strong and prosperous nation, which
is modern, progressive and enlightened in outlook and which proudly draws
inspiration from India's ancient culture and values and thus is able to emerge
as a great world power playing an effective role in the comity of nations for
the establishment of world peace and a just international order.
এখানের মুল তাৎপর্যপূর্ণ শব্দগুলি হল “ancient” , “culture” , “values” । এবং এর থেকে বোঝা যায় বিজেপির মুল দর্শন হল প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতিকে আধার করে আধুনিক ভারত গড়ে তোলা। খুবই স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারনা।
এবার কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) -এর নিয়মতন্ত্রের আর্টিকেল ২ (Aim) -এর প্রথম পরিচ্ছেদে পাই
The Communist Party of India (Marxist) is the revolutionary vanguard of the
working class of India. Its aim is socialism and communism through the
establishment of the state of dictatorship of the proletariat. In all its
activities the Party is guided by the philosophy and principles of
Marxism-Leninism which shows to the toiling masses the correct way to the ending
of exploitation of man by man, their complete emancipation. The Party keeps high
the banner of proletarian internationalism.
সিপিআই(এম) এর দর্শন খুব সহজ, তারা মার্ক্স-লেনিন বাদে বিশ্বাসী, এবং তারা ভারতে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠাতে আগ্রহী। এটিও খুব স্পষ্ট।
এবার যদি তৃণমূলের নিয়মতন্ত্রের আর্টিকেল ১ (Aim) থেকে আমরা পাই
The aim of the Party shall be to make all round development of India in the
political, economic, industrial, social, cultural, agricultural sectors and to
establish India as a global power keeping in view the multi-lingual,
multi-faceted, multi-ethnic, rich culture and heritage of India.
উফঃ এই এতগুলি শব্দ ব্যায় বৃথা, এটি কোনো দর্শন ব্যাক্ত করেনা। আবার নিয়মতন্ত্রের আর্টিকেল ২ (Objective) থেকে আমরা তিনটি “পয়েন্ট” খুঁজে পাই
(a) To uphold and adhere, with true faith and allegiance, to the Constitution of
India as by law established.
(b) To uphold and work for the furtherance of the principles of Nationalism,
Socialism, Secularism and Democracy.
(c) To eradicate illiteracy, poverty and injustice and cause upliftment of the
downtrodden by ensuring social equality, awakening of the masses by peaceful
means, movement and participation in the lawful electoral process.
যার মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমরা ভারতের সংবিধান মানবো এবং অন্যায়, অবিচার, নিরক্ষরতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করবো।
এতগুলো শব্দ ব্যায় করা হল কিন্তু দর্শন বা আদর্শ আমি খুঁজে পেলাম না। তাহলে এই দলগুলি টিকে আছে কী করে?
এই দলগুলো টিকে আছে কারণ তারা ক্ষমতায় আছে। এদের জন্ম অন্য কোনো দলের “Anti” বা বিপক্ষ হয়ে, যেমন তৃণমূলের জন্ম Anti-সিপিআই(এম) হিসাবে, আম আদমি পার্টির জন্ম Anti-কংগ্রেস-জোট (UPA) হিসাবে।
এই “Anti” দলগুলি তত দিনই টিকবে যতদিন এরা ক্ষমতায় আছে, কারণ তারা যে দলের বিপক্ষ হয়ে ক্ষমতায় এসেছে তারা বর্তমানে ক্ষমতায় নেই অর্থাৎ তাদের কাছে ওই দলের বিরুদ্ধে বলার নতুন কথা আস্তে আস্তে সীমিত হয়ে উঠবে এবং একসময় যখন তারা আর ক্ষমতায় থাকবে না, তারা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিশে যাবে। তবে আদর্শহীন দল মাঝে মাঝে ক্ষমতায় আসা গনতন্রের পক্ষে ভালো তাছাড়া উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে, তবে দিন শেষে সেই আদর্শবাদী দলগুলিই টিকে থাকবে।