স্পর্শ এক ভ্রম
ছুঁয়েও ছুঁতে পারি না কিছু
মনে হয় আছি শুধু পিছু”
তুমি এই নিবন্ধটি এখন যে মাধ্যমেই পড়না কেন , পড়ার সময় তুমি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু স্পর্শ করে আছ , হয় মোবাইল , হয় ল্যাপটপ , কম্পিউটার না হয় অন্য কিছু। তুমি শুনলে হয়তো অবাক হবে যে আসলে তুমি এখন কিছুই স্পর্শ করছ না। সবই তোমার মস্তিষ্কের ছলনা মাত্র। পদার্থবিজ্ঞান বলে যে , শুধু আমরা নই , যেকোনো দুটি বস্তু পরস্পরকে সত্যিকারের স্পর্শ করতে পারে না।
বিশ্বাস হচ্ছে না? চিন্তা নেই আমি তো আছি , সব সহজ করে বোঝাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি –
তোমরা হয়তো জানো যে , আমরা প্রত্যহিক জীবনে যা কিছু দেখি, ছুঁই বা অনুভব করি সবকিছুই অণু দ্বারা গঠিত। অণু হল যেকোনো বস্তুর ক্ষুদ্রতম একক যাতে ওই বস্তুর সকল গুণাগুণ বর্তমান থাকে। বিজ্ঞানের যে শাখায় এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয় তাকে বলে কোয়ান্টাম বা ক্ষুদ্রাংশিক পদার্থবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানে এমন এমন সব আলোচনা ও তথ্য আছে যা তোমার আমার পারিপার্শ্বিক বিশ্বের প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দেবে । আজ থাক , অন্য একদিন না হয় আলোচনা করা এই যাবে এই কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে।
যাদের মাধ্যমিকস্তরের বিজ্ঞান সম্পর্কে একটুও ধারনা তারা নিশ্চয়ই জানবে যে পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে অণু আবার এই অণুর মধ্যে রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ দুই বা তার বেশি তড়িৎ নিরপেক্ষ পরমাণু থাকে। এই পরমাণুর মাঝখানে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন সম্বলিত নিউক্লিয়াস । এই নিউক্লিয়াসের মধ্যেই পরমাণুর সমস্ত ভর অন্তর্নিহিত থাকে , এবং এর চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রন আবর্তন করে। এই ইলেকট্রনগুলি হয় ঋণাত্মক আধানযুক্ত এবং নিউক্লিয়াসের প্রোটন হয় ধনাত্মক আধানযুক্ত আর নিউট্রন হয় আধানহীন।
যেকোনো কণার একটি সাধারণ ধর্ম হচ্ছে বিপরীত আধানযুক্ত কণাকে আকর্ষণ ও সম আধানযুক্ত কণাকে বিকর্ষণ করা। ফলাফল স্বরূপ , ইলেকট্রন অন্য ইলেকট্রনকে বিকর্ষণ করে আবার বিপরীত আধানযুক্ত প্রোটনকে আকর্ষণ করে। এর জন্যে দুটি ইলেকট্রন কখনই পরস্পরকে স্পর্শ করে না। অর্থাৎ যখন তুমি চেয়ারে বস তখন তোমার শরীরের ইলেকট্রনসমূহ চেয়ারের ইলেকট্রনসমূহকে বিকর্ষণ করে। যেহেতু আমরা আগেই জেনেছি যে ইলেকট্রন কখনই পরস্পরকে স্পর্শ করে না তাই, তোমার শরীরও কখনই চেয়ারকে স্পর্শ করে না ফলে তুমি চেয়ারের উপর ভেসে থাকো, যদিও তোমার শরীর ও চেয়ারের পারস্পরিক দূরত্ব এতই নগণ্য হয় যা তা আমাদের বোধগম্য হয় না।
একটা ছোট্ট হাতে কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যপারটি আরও সহজে বুঝতে পারবে। প্রথমে তোমাকে শক্তিশালী দুটি চুম্বক জোগাড় করতে হবে , তবে দণ্ড চুম্বক হলে ভালো হয়। বিদ্যালয়ে এরকম চুম্বক থাকতে পারে , সেখানেও তুমি এই পরীক্ষাটি করতে পার তা না সম্ভব হলে বাজারে বা অনলাইনে খুব সহজেই এই ধরনের চুম্বক পেয়ে যাবে। প্রথমে চুম্বকদুটিকে টেবিলে বা কোন সমতল স্থানে চিত্রের মত করে রাখতে হবে।
যদি তোমার চুম্বক গুলিতে ‘N’ এবং ‘S’ না লেখা থাকে তাহলে পরস্পর বিকর্ষণকারী দুটি সম্মুখকে মুখোমুখি রাখলেই হবে। এবার তুমি আস্তে আস্তে চুম্বকদুটিকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে থাকো। দেখবে যত কাছাকাছি আনবে ততই বিকর্ষণ বল আরও শক্তিশালী মনে হবে। যদি চুম্বকদুটি যথেষ্ট শক্তিশালী হয় তবে পুরো শরীরের জোর দিয়েও কোনোমতেই দুটো চুম্বককে ছোঁয়াতে পারবে না। চেয়ার ও তোমার শরীরও কিছুটা একইভাবে দুটি চুম্বকের মত কাজ করে। এবার হয়তো বুঝতে পারছ যে তোমার শরীর ও চেয়ার আসলে কোনভাবেই এক অপরকে স্পর্শ করে না এবং দুটি পদার্থের মধ্যবর্তী দূরত্ব নির্ভর করবে দুটি পদার্থের ইলেকট্রনের উপর।
স্বাভাবিক ভাবেই তোমার এবার কৌতূহল হতেই পারে যে , আমরা আসলে যদি কোনো কিছু ছুঁতে পারি না তাহলে আমাদের স্পর্শের অনুভূতি কেন এবং কিভাবে সৃষ্টি হয়। এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে আমাদের ভৌতবিশ্বকে গ্রহণ ও ব্যখ্যা করে। আমাদের ত্বকের স্নায়ুগুলি আমাদের মস্তিষ্কে স্পর্শের বার্তা প্রেরণ করে যখনই আমাদের ত্বকের ও অন্য কোনো বস্তুর ইলেকট্রণের মধ্যে পরস্পর বিকর্ষণ হয়।
এবার হয়তো বুঝতে পারছ যে, স্পর্শ একধরনের মহাবিভ্রম ছাড়া আর কিছুই না। স্পর্শ আমাদের মস্তিষ্কের ছলনামাত্র যাতে করে আমাদের চারপাশের পরিবেশকে সহজভাবে বুঝতে পারি।
তথ্যসূত্রঃ ১।
২।
বিঃদ্রঃ শুরুর কবিতার লাইনটি তরুণ বাউরির লেখা ( Tarun Bauri )