সমাজ ও সিনওলি

আমি গতপরশু একটি সুন্দর তথ্যচিত্র দেখলাম - “Secrets of Sinauli”। সিনওলি গ্রামে আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নিয়েই এই তথ্যচিত্র এবং এই আবিষ্কার আমাদের বর্তমান ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে কিভাবে প্রভাবিত করে তাও এই তথ্যচিত্রে আলোচনা করা হয়। সত্যি কথা বলতে আমার এটি অসাধারণ লেগেছে; এর দ্বারা আমার অতীতের ভারতবর্ষ সম্পর্কে যেরকম মানসচিত্র ছিল তা অনেকটা বদলে গেছে সাথে সাথে বর্তমানকেও নতুন আঙ্গিকে দেখতে শিখেছি। 

 

সিনওলি হল উত্তরপ্রদেশের একটি গ্রাম; দিল্লি থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৬৭ কিলোমিটার। সেই এক প্রত্যন্ত গ্রামে একদিন যখন কৃষকরা মাটি খুঁড়ছিল হঠাৎ তারা মাটির ভিতর থেকে খুঁজে পেল অনেক তামার পাত্র , সোনার গয়না ইত্যাদি। চারিদিকে খবর ছড়িয়ে গেল, প্রশাসনের কাছেও খবর গেল। ২০০৫ সালে সেখানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই) এসে পৌঁছাল। তারা বিশেষ কিছু স্থান নির্বাচন করে এবং সেই স্থানগুলি সুরক্ষিত করা হয়, কারণ সেখানকার  সাধারণ জনগণ ভেবেছিল হয়তো কোনো দেবদেবীর আশীর্বাদের ফলে এইসব সোনার,তামার জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ খোঁড়াখুঁড়ি করে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি নষ্ট করে ফেলছিল। 

স্থানগুলি সুরক্ষিত করার পর, ডঃ ডি.ভি. শর্মার নেতৃত্বে সেখানে এ.এস.আই তাদের কাজ শুরু করে। সেখানে তারা প্রায় ১১৬টি সমাধিস্থল উদ্ধার করে। যাকে এশিয়ার সর্ববৃহৎ সমাধিস্থল বলে গণ্য করা হয়। এত বড় আবিষ্কার, কিন্তু বিভিন্ন কারণে ২০০৫ এর অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। 

আস্তে আস্তে সময় প্রভাবিত হল , মানুষের মন থেকে সিনওলির নাম চাপা পড়তে থাকে সাথে সাথে হাজার বছরের ইতিহাসও সিনওলির মাটিতে চাপা পড়েই থেকে যায়। ১৩ বছর পর, ২০১৮ এ আবার সেখানে এ.এস.আই সঞ্জয় মঞ্জুলের নেতৃত্বে অভিযান চালায়। 

২০১৮ তে সমাধিস্থল গুলি থেকে মানব কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়। নানান মাটির ও তামার পাত্র, গয়না ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয় এই সমাধিগুলি থেকে; সাথে সাথে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র যেমন ধনুক, তলোয়ার, ঢালও পাওয়া যায় এখানে থেকে। এগুলি থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করেন যে এই সমাধিগুলি হল আসলে যোদ্ধাদের। এছাড়া কয়েকটি মহিলার সমাধিও পাওয়া যায় এবং তাদের সাথে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রও পাওয়া যায়। এগুলি ছাড়াও একটি রাজকীয় সমাধির হদিস পান তারা, সেই সমাধিতে কয়েকটি রথের প্রতিকৃতি পাওয়া যায় যা ভারতে পাওয়া প্রথম ঐতিহাসিক রথ।

এইসব আবিষ্কার আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে। এই সিনওলির আবিষ্কার কিন্তু অনেক পুরাতন তত্ত্বের ভিতকে নড়িয়ে দেয়। 

এখানে পাওয়া মাটির, তামার পাত্র ও গয়না তৈরির গঠনশৈলী জানান দেয় যে তারা পাশাপাশি অন্যান্য সভ্যতার থেকে অনেক উন্নত ছিল। তাছাড়া তারা কলা ও হস্তশিল্পেও যে প্রভূত উন্নত ছিল তা আমরা তাদের এই শিল্পকলাগুলি থেকে জানতে পারি।

সমাধিগুলিতে অস্ত্রের অস্তিত্ব এই প্রমাণ করে, সিন্ধু সভ্যতা , হরপ্পা সভ্যতার মানুষ যেমন শান্তিপূর্ণ ছিল বা তাদের সমাজে কোনো যুদ্ধের বা অস্ত্রের উপস্থিতির বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় না; কিন্তু এই সিনওলির মানুষ কিন্তু যুদ্ধে পারদর্শী ছিল, এবং এই সমাধিস্থলগুলি মূলত যোদ্ধাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ছিল। 

এছাড়া মহিলা যোদ্ধাদের সমাধি জানান দেয় যে সেই সময়ে নারীদের সমাজের অবস্থান সম্পর্কে ধারনা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞ যেমন কে.এন দীক্ষিত এর মতে নারী সমাধির সাথে অস্ত্রের অস্তিত্ব জানান দেয় যে সেই সময় নারীরাও যোদ্ধা ছিল। এবং তারাও পুরুষদের সমকক্ষ ছিল। এছাড়া আমরা সেই সময়সাময়িক বিভিন্ন সভ্যতার থেকে প্রমাণ পাই যে সমাজের নারীর বিশেষ সম্মান ছিল। 

আবার প্রাচীন ভারতের প্রথম রথের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এই সমাধিগুলি থেকে। অনেক পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক মনে করতেন যে ভারতে রথের প্রচলন অনেক পরে শুরু হয় কিন্তু এই আবিষ্কার তাদের তত্ত্বের ভিতকে নড়িয়ে দেয়। এছাড়া রথের উপর তামার কারুকার্য তাদের উন্নত শিল্পকলার প্রদর্শন করে। তবে এই রথ নিয়ে আরেকটি বড় মতভেদ দেখা যায়, যে এই রথ কোন প্রাণীতে টানত; অনেকে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ যেমন বিজয় সাথে, নীরজ রায়, বি.আর মনি প্রমুখদের মতে এগুলি ঘোড়ায় টানা রথ ছিল কিন্তু পাশ্চাত্যের বিশেষসজ্ঞদের মতে ভারতে ঘোড়ার আবির্ভাব অনেক পরে হয় মূলত আর্যদের হাত ধরে। এই নিয়ে এক মতভেদ এখনো বর্তমান। 

 

সিনওলির মানুষেরা কি করত আমরা জানতে পেরেছি কিন্তু তাদের পরিচয় আজও জানতে পারিনি। সিনওলির আবিষ্কার আমাদের ইতিহাসকে বিদেশিদের দ্বারা যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছিল তাকে উদ্ধার করতে অনেক সাহায্য করবে, তা আমার সহ অনেক বিশেষজ্ঞের মত। 

আমি সবাইকে বলবো যাতে তারা উক্ত তথ্যচিত্রটি দেখে। এটি থেকে তারা অনেক কিছুই জানতে পারবে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে; সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্বচ্ছ করতে সাহায্য করবে এই তথ্যচিত্র। 

[সমস্ত ছবি Secrets of Sinauli তথ্যচিত্র থেকে; কপিরাইট তথ্যচিত্র নির্মাতাদের]

ইতিহাস ছিল পরতে পরতে লুকিয়ে / উদ্ধার করতে হবে আমাদেরই 

~ পলাশ বাউরি

✏️ শেষ সম্পাদনাঃ বুধ, 25 জানুয়ারি 2023 | 📎 লিঙ্ক
এক লেখাটি সম্পর্কে কোনো মতামত আছে 🤔? তাহলে আমাকে ইমেল পাঠান (নীচে দেওয়া আছে) কিংবা টুইটারে বা ফেসবুকে আমাকে @bauripalash মেনশন করে পোস্ট করুন 😺!

আমার লেখাগুলো বা অন্যকোনো কাজ ভালো লাগছে? তাহলে এক কাপ চা খাওয়ান