মৎস্যশাঁস
১৫ জানুয়ারি , ২০২১
প্রথম খণ্ডে আমি আলোচনা করেছিলাম , মাছ কিভাবে অবহেলিত ও নির্যাতিত। অন্যান্য জীবদের জন্যে আমরা যেভাবে সমব্যাথি হয় তার সিকিভাগও আমরা মাছেদের জন্য হইনা।
আজকের দ্বিতীয় খণ্ডের আলোচনা শুরুর আগে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত - ইংরাজি শব্দ Flesh এর বাংলা প্রতিশব্দ কী? সংসদের ইংরাজি-বাংলা অভিধান অনুযায়ী এর বাংলা প্রতিশব্দ হল জীবদেহের মাংস যা সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ায় শুধু মাংস! আবার যদি জিজ্ঞেস করি, Meat শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কী? সংসদের ইংরাজি-বাংলা অভিধান থেকে পাই - ভক্ষণযোগ্য মৃগমাংস যা চলতি কথায় আবার সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ায় শুধু মাংস! অর্থাৎ এবার সহজ ভাবেই একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে যে , আমাদের বাংলা ভাষায় জন্য ফ্লেশ বা মিটকে পৃথক করার জন্য একটি নতুন শব্দের প্রয়োজন । আর যতদিন তা না হচ্ছে , আমার মতে Flesh কে প্রাণীশাঁস বলা যেতেই পারে!
এবার আমাদের মুল আলোচনায় ফিরে আসা যাক , মাছ বা মাছের প্রাণীশাঁস কেন মাংস নয় ? (উপরের আলোচনাটি মাথায় রাখো , এখানে মাংস বলতে Meat কে বোঝাচ্ছি। ) এটি বহুকাল ধরে চলে আসা একটি বিতর্ক। অনেকের মতে মাছ বা মাছের প্রাণীশাঁস মাংস নয় আবার অনেকে বলে এটি মাংস! অনেক নিরামিষাশী মানুষ আবার মাছ খান এই যুক্তিতে যে মাছকে মুরগি , ছাগল বা অন্য কোনো মাংসের সাথে এক শ্রেণিতে ফেলা যায় না। যদিও এটি প্রমাণিত সত্য যে মাছও কিন্তু একটি প্রাণী (Animal) কারণ মাছ আনিমিলিয়া রাজ্যের জীব। তাদের প্রাণীশাঁস আবার প্রাণীজ প্রোটিন দ্বারাই গঠিত, অর্থাৎ সেই প্রাণীশাঁসকে ভোজ্য হিসাবে গ্রহণ করলে তাকে মাংস বলা চলে কারণ , সংসদের অবিধান অনুযায়ী মাংস শব্দের অর্থ হল - ***১. জীবদেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী কোমল অংশবিশেষ; ২. মানুষের ভোজ্য মানুষ্যেতর প্রাণীর আমিষ বা পলল । ***
প্রথম অর্থটি স্পষ্টভাবেই প্রাণীশাঁস বা ফ্লেশের কথা বলছে কিন্তু দ্বিতীয় অর্থটিতে মিট -এর কথা বলা আছে এবং সেখানে উল্লেখ করা আছে “প্রাণীর আমিষ” অর্থাৎ, অভিধানগত ভাবে দেখতে গেলে মাছ বা মাছের প্রাণীশাঁস স্পষ্টতই মাংস।
এবার হতেই পারে, তোমার অভিধানগত ব্যাখ্যা ভালো লাগলো না । তাই চলো একবার দেখি আসি মাছ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের কিরকম মতামত , কারণ আমরা সবাই জানি ভারত একটি সব ধর্মের সমন্বয়ের দেশ -
ইসলামধর্ম - ইসলাম ধর্মে একেবারে শক্ত নিয়মকানুন আছে খাদ্যের ব্যাপারে । তারা আবার মাছ ও মাংসকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে রাখে। মাংসকে হালাল বা অনুমোদনযোগ্য হওয়ার জন্য শক্ত নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয় । কিন্তু মাছের ক্ষেত্রে তেমন কোনো নিয়ম নেই। মাছের যদি আঁশ থাকে তাহলে সেটি হালাল হয় এবং বিশেষ কোনো প্রক্রিয়াকরণ প্রয়োজনীয় হয় না । [১]
হিন্দুধর্ম - হিন্দু ধর্মে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে খাদ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারভেদ দেখা যায় এবং মাছ সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা আলাদা হয়। কোনো কোনো সম্প্রদায় মাছ ও মাংসে আলাদা আলদা শ্রেণিতে রাখে আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় একই শ্রেণিতে রাখে। যদিও বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মগ্রন্থে অহিংসার কথা বলে, তাই অনেক মানুষই সম্পূর্ণ নিরামিষাশী জীবনযাপন করেন - তারা মাছ , মাংস , ডিম কিছুই খান না। আবার হিন্দুদের অনেক অনুষ্ঠান হয় যেখানে , মাংস খাওয়া চলে না , কিন্তু মাছ খাওয়া চলে। [১]
খ্রিস্টধর্ম - কিছু কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায় মাছ মাংস কিছুই খায় না। বাইবেলও মাছ মাংসের মধ্যে খুব একটা কঠিন পৃথকীকরণ করে না , বাইবেলে বলে যে যেসব মাছের পাখনা ও আঁশ আছে এবং যেসব প্রাণীর খুর আছে এবং জাবর কাটে তাদের খাওয়া যায়। যদিও জিশুখ্রিস্ট সব খাবারই খাওয়া যায় বলেছেন, যদিও ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বাইবেলের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বার করেছেন । যদিও অনেকে বলেন যেহেতু জিশুখ্রিস্ট শুক্রবারের দিন মারা গেছিলেন তাই সেদিন উপবাস করা উচিত। আবার অনেকে মনে করেন সেদিন শুধু গরম রক্তযুক্ত প্রাণী খাওয়া যায় না , তাই অনেকেই সেদিন মাছ খান। [১]
এবার যদিও আমার সহজ ভাবে বলতে পারি যে মাছ বা মাছের প্রাণীশাঁস আসলে হল মাংস। এমনকি মার্কিন কৃষি মন্ত্রকও মাছ ও মাংস এবং প্রোটিনের অন্য উৎসগুলিকেও একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মনে করে। এছাড়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখলে এটাই দাঁড়ায় যে , মাছ ও মাংস একই শ্রেণিভুক্ত।
এবার যদি আমরা মেনেনি যে, মাছ মাংস সমগোত্রীয় তাহলে কিন্তু আমাদের অনেক ধারনা ও বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরে গুঁড়ো হয়ে যাবে। যদি শেষ সিধান্ত সম্পূর্ণ তোমার উপরেই, তুমি মাছ ও মাংসকে একই শ্রেণিভুক্ত করবে নাকি আলাদা!
[এটি গতকাল শুরু হওয়া মৎস্য সিরিজের দ্বিতীয় ও অন্তিম খণ্ড]
মৎস্য নাকি মাংস / কোনটা খাব কোনটা ছেড়ে!
~ পলাশ বাউরি