মিম পুরাণ

অনেক আগে সুকুমার রায় বলে একজন সাহিত্যিক (আশা করি তোমাদের অচেনা নয় 😁 ) তার কবিতায় বলেছিলেন “গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা” । তবে এখনকার সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী তরুণ তরুণীরা কিশোর কিশোরীরা বলবে , “মিমের আমি মিমের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা”। ইন্টারনেট পাড়ার মোড়ে মোড়ে এখন মিমেরই ছড়াছড়ি , মনে হবে যেন কোন এক উন্মাদ শিল্পী নিজের শিল্পকলার প্রদর্শন করছে! আর একজন ইন্টারনেট পাড়ার বাসিন্দার (যেমন আমি , তুমি) বাড়ির দেওয়ালে আঁকা মিম দেখে তার চিন্তাধারা , মানসিকতা এবং রুচিবোধ সম্বন্ধে বিস্তর ধারনা পাওয়া যায়।

তোমরা যদি স্থায়ী বাসিন্দা নাও হও কিন্তু যদি এই কয়েকবছরের মধ্যে একবারের জন্যেও আমাদের এই ইন্টারনেট পাড়ায় এসেছ তাহলে, ৯৯.৯৯ শতাংশ সম্ভাবনা আছে যে তুমি একবার না একবার মিমের সম্মুখীন হয়েছ। মিম সম্বন্ধে সবারই কম বেশি এক-আধটু ধারনা আছে , কিন্তু মিমের ইতিহাস সম্বন্ধে সবাই জানো কি? বেশিরভাগই উত্তর দেবে “না!” , তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে চল শুনেনি “মিম পুরাণ”!!

সালটা ১৯৭৬, একজন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী ও লেখক, ক্লিনটন রিচার্ড ডকিন্স , তাঁর বই “দি সেলফিস জিন” এ কিভাবে সাংস্কৃতিক তথ্য বা ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমবার “মিম” (meme) শব্দটির ব্যবহার করেন । তিনি এই শব্দটি নেন গ্রিক শব্দ “Mimeme” থেকে, যার অর্থ “অনুকরণ করা বা নকল করা (to imitate)” , কিন্তু তিনি জিন (gene) শব্দের সাথে সাদৃশ্য রাখার জন্য “Mimeme” কে সংক্ষিপ্ত করে “মিম” (meme) এ পরিবর্তিত করেন। ডকিন্সের মতে “মিম হল একটি চিন্তা বা ধারণা , যা পোশাকের আদব-কায়দা , কোন উক্তি এমনকি কোন স্থাপত্য নির্মাণের পদ্ধতিও হতে পারে…” । তবে বর্তমানের আধুনিক মিম ডকিন্সের মতবাদ থেকে অনেকটাই আলাদা ।

আধুনিক মিমের শুরুটা হয় শুধু লেখা দিয়েই , মিমে ছবির ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরে। ছবি যুক্ত মিমের মধ্যে অন্যতম হল ১৯৯৬ এর সারা ইন্টারনেটে ছেয়ে থাকা “নৃত্যরত শিশু (Dancing Baby)”

এটি একটি নৃত্যরত শিশুর ত্রিমাত্রিক ভিডিও , এটি আবার অন্যতম প্রথম ভিডিও মিমেরও উদাহরণ।

তবে এবার তোমরা আবার এটা ভেবো না যে ডকিন্স বা নৃত্যরত শিশুর আগে মিম বলে কিছু ছিল না , ইন্টারনেট মিমের আগেও দেওয়াল লিখনে , খবরের কাগজে এমনকি কিছু স্থাপত্যতেও মিমের নিদর্শন পাওয়া যায় ! তবে বর্তমানের মিম আগের মিমের থেকে অনেকটাই আলাদা । মিমের রূপ , মিমের বক্তব্য হোক বা মিম প্রচারের মাধ্যম সবটাই এখন বদলে গেছে। এই বদলের ফলে দেশে দেশে তৈরি হয়েছে মিম নিয়ে বিভিন্ন আইনও।

যেমন ভারতে , ভারতীয় কপিরাইট অ্যাক্ট ১৯৫৭ এর সেকশন ২(C) অনুযায়ী মিম হল একধরনের “শিল্প কর্ম” , অর্থাৎ অন্যান্য শিল্পকর্ম যেমন চিত্রকলা , ক্যামেরায় তোলা ফটো বা স্থাপত্য প্রভৃতির নকল করলে বা শিল্পীর অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে যেমন আইনি সাজা হতে পারে মিমের ক্ষেত্রেও সেই একই ধরনের সাজা হতে পারে (ফেসবুকের মিম পেজেরা সাবধান! ) । তবে ন্যায্য ব্যবহার (fair dealing) নীতি মিমের বাক্তিগত ব্যবহার , গবেষণার কাজে ব্যবহার , সমালোচনা বা পর্যালোচনা ইত্যাদি কাজে ব্যাবহারে কপিরাইট অ্যাক্ট ছাড় দেয় যতক্ষণ না নির্দিষ্ট মিমটি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ।

সবশেষে বলবো , মিম একটি আকর্ষণীয় আবিষ্কার কিন্তু একে কোন বাক্তির মানহানি বা সকলের সামনে ছোট করে দেখানোর জন্য ব্যাবহার করা উচিত নয় যা আজকাল খুবই বেশি দেখা যায় । “সুস্থ মিম তৈরি কর , সুস্থ মিম শেয়ার কর” কারণ ওই যে প্রথমেই বলেছি “মিমের আমি মিমের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা”……


তথ্যসূত্র :

  1. The Selfish Gene by Richard Dawkins, p. 192 (ISBN 978-0-19-286092-7)

  2. The Copyright Act, 1957

✏️ শেষ সম্পাদনাঃ বুধ, 25 জানুয়ারি 2023 | 📎 লিঙ্ক
এক লেখাটি সম্পর্কে কোনো মতামত আছে 🤔? তাহলে আমাকে ইমেল পাঠান (নীচে দেওয়া আছে) কিংবা টুইটারে বা ফেসবুকে আমাকে @bauripalash মেনশন করে পোস্ট করুন 😺!

আমার লেখাগুলো বা অন্যকোনো কাজ ভালো লাগছে? তাহলে এক কাপ চা খাওয়ান