কোয়ালা!
সেদিন ইন্টারনেট পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে একটা খবর দেখতে পেলাম, পোর্ট ম্যাকওয়ারির কাছে লাগামহীন দাবানলে শত শত কোয়ালার জীবন্ত দহনের আশঙ্কা করা হচ্ছে । খবর শুনে দুঃখ পেলাম, প্রিন্স ইএ -এর একটা ভিডিওর লাইন মনে পড়ে গেল, …পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করো পশুপাখিদের আমরা বিলুপ্তির খাদে ঠেলে দিয়ে তোমাদের তাদের সাথে বন্ধু হওয়ার সুযোগটুকুও কেড়ে নিয়েছি… ।
কোয়ালা, অনেকে বলে কোয়ালা ভালুক , যেটা আসলে ঠিক নয় কোয়ালার সাথে ভালুকের দূর দুরান্ত পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই।
কোয়ালা সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার ইউক্যালিপটাস বনভূমিতে বাস করে তবে রেড লিস্টে এই প্রজাতিকে সংকটাপন্ন প্রাণীর তকমা দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন নতুন জায়গাতে (কয়েকটি দ্বীপে) এদের বাস করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
[লাল রং চিহ্নিত স্থানে কোয়ালার স্বাভাবিক বাসস্থান, বেগুনি রং চিহ্নিত এলাকায় বর্তমানে নতুন আবাস তৈরি করা হয়েছে (সূত্র)]
কোনোদিন যদি অস্ট্রেলিয়া যাও তাহলে কোয়ালা চিনতে খুব একটা অসুবিধা হবে না, দেখবে গাছের ডাল ধরে ঝুলে আছে আছে বাচ্চাদের টেডি বিয়ারের মত একটা প্রাণী! লেজবিহীন শরীরের রং ধূসর বা চকলেট বাদামি, চামচের মত একটা নাক, গোল গোল দুটো চোখ আর বড়, গোল একটা মাথা আর তার ওপর প্রচুর লোমযুক্ত বড় বড় দুটো কান। এরা লম্বায় প্রায় ৬০-৮৫ সেন্টিমিটারের মধ্যেই হয় তবে উত্তরাঞ্চলের থেকে দক্ষিণাঞ্চলের কোয়ালারা একটু আকারে বড় হয়।
কোয়ালা নামটার উৎপত্তি নিয়ে একটা মজার ব্যাপার আছে, কোয়ালা শব্দটির উৎপত্তি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ভাষা ‘ধারুগ ' এর ‘গুলা’ (gula) শব্দ থেকে যার অর্থ জল ছাড়া বা জলহীন। কিন্তু ইংরেজি লেখনী রীতিতে এই ‘u’ কে ‘oo’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়, যার বানান হওয়া উচিত ছিল coola বা koolah কিন্তু কোনো অজানা ত্রুটির কারণে এটি ‘oa’ তে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
কোয়ালার প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় জন হান্টার, নিউ সাউথ ওয়েলস এর গভর্নরের ভৃত্য জন প্রাইসের লেখা থেকে। তিনি এই কোয়ালা দের সাক্ষাত পান ১৭৯৮ এ কিন্তু এই তাঁর বিবরণ প্রকাশিত হয় প্রায় একশো বছর পর । অন্যদিকে এর প্রথম ছবি প্রকাশিত হয় জর্জ পেরির ‘আর্কানা’ (Arcana) (১৮১০) নামক গ্রন্থে।
[১৮১০এ আর্কানাতে প্রকাশিত কোয়ালার প্রথম ছবি]
কোয়ালা একটু অসামাজিক প্রকৃতির প্রাণী , এরা দিনে গড়ে মাত্র ১৫ মিনিট সামাজিক কাজকর্ম করে । কোনো কোয়ালা যখন নতুন কোনো গাছে প্রবেশ করে তার এলাকা চিহ্নিত করার জন্য নিজের বুকের একধরনের গ্রন্থি গাছে ঘষতে থাকে , এর থেকে উৎপন্ন গন্ধ অন্য কোয়ালাদের সঙ্কেত দেয় যে এই গাছটি ইতিমধ্যেই অধিকৃত হয়ে গেছে।
এ তো গেল পুরুষ কোয়ালাদের বৈশিষ্ট্য , অন্যদিকে স্ত্রী কোয়ালাদের কথাই আসি , পুরুষ কোয়ালার থেকে স্ত্রী কোয়ালা আকারে অনেকটাই ছোটো হয় । এরা পরিচিত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী পুরুষ কোয়ালাকে জনন সঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করে । এদের গর্ভধারণকাল প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যেই হয়, এই সময়কালের পর স্ত্রী কোয়ালা একটিই মাত্র শিশুর জন্ম দেয় , কোয়ালার শিশুকে জোয়ি (Joey) বলে । এই বাচ্চারা অপরিনত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে , এদের ওজন তখন ৫০০ গ্রাম বা তারও কম হয় কিন্তু তাদের পাচকতন্ত্র , শ্বাসতন্ত্র ও মূত্র প্রণালীর মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাবস্থা সম্পূর্ণ কার্যকর অবস্থায় থাকে ।
[জোয়ির তার মায়ের সাথে (সূত্র)]
স্ত্রী কোয়ালারও ক্যাঙ্গারুদের মত পেটে একধরনের থলি থাকে, জন্মের পরেই জোয়ি তার মায়ের পেটের থলির মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং তার বাকি বিকাশ সম্পূর্ণ করে ।
কোয়ালারা সাধারণত ১৪ থেকে ১৮ বছর বাঁচে ।যদিও পুরুষদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাত্রার কারণে স্ত্রী কোয়ালারা পুরুষদের থেকে বেশিদিন বাঁচে ।কোয়ালার ডিঙ্গো (এক ধরনের অস্ট্রেলীয় কুকুর) বা পাইথন/অজগর ছাড়া তেমন কোনো শিকারি নেই তবে বাচ্চা জোয়িদেরকে মাঝে মাঝে ঈগল বা এইধরনের শক্তিশালী পাখিরা তুলে নিয়ে চলে যায় ।
এত সুন্দর একটি প্রাণী , তবুও মানুষেরা অযথা শুধুমাত্র লোমের জন্য এদের হত্যা করে , এই হত্যার কারণে ২০১৬ সালে কোয়ালাকে সঙ্কটাপন্ন প্রাণীর তকমা দেওয়া হয়েছে ।
[বিংশ শতাব্দীতে কোয়ালার চামড়ার জন্য প্রচুর কোয়ালা হত্যা করা হত]
আবার কদিন আগেই দেখলাম লাগামহীন দাবানলে শত শত কোয়ালার জীবন্ত দহনের আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই নিরীহ প্রাণীরা তাদের মন্থর গতির জন্য আগুণ থেকে বেরতেও পারেনি!
পরিবেশের এই অদৃশ্য আগুণ না নেভাতে পারলে একদিন এই আগুণের আঁচেই মানব সভ্যতা নিজেদের তৈরি কলকারখানার দুষিত ধোঁয়াতে ছাই হয়ে মিশে যাবে ।
ছবিসূত্র:
- প্রথম ছবি - 2. উইকিমিডিয়া কমন্স
তথ্যসূত্র :
-
Australian Aboriginal Words in English: Their Origin and Meaning (2nd ed.) by R. M. W. Dixon, Bruce Moore, Mandy Thomas, Oxford University Press. p. 65.
-
Walker’s Marsupials of the World (Walker’s Mammals) by Ronald M. Nowak , The Johns Hopkins University Press. pp 135-136